আমাদের সমাজে নারীর মানুষ হিসাবে কোন স্বীকৃতি নেই। তার জীবন-মরণ দোদুল্যমান পুরুষের হাতের মুঠোয়।পুরুষশাসিত এই সমাজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সুরে তার দিন-যাপনের তারটি বাঁধা। এমনকি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মুহূর্তেও তাকে তাকিয়ে থাকতে হয় পুরুষের মুখের দিকে। সে সিদ্ধান্ত তার বেচে থাকা না থাকা সম্পর্কেও হতে পারে।
একজন নারী তার পরিচয় হিসাবে জানে সে কারো কন্যা,কারো ভগ্নী,কারো স্ত্রী, কারো মা। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সে ভিন্ন ভিন্ন পুরুষের অধীনস্ত হয়ে জীবন কাটায়।পুরুষ যে দিক নির্দেশনা দেয়, সে পথেই নারী রাখে তার ভীরু পদচিহ্ন। এদেশে অনেক মেয়ে আছে যে বিয়ের পর ধীরে ধীরে তার নিজের নাম পরিচয় ভুলে যায়। অমুকের স্ত্রী থেকে অমুকের মা হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত সে নীরবে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়। এমন শর্তহীন আত্নসমর্পণের পরেও তার নিস্তার নেই। সমাজের যেকোন ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য তাকে হতে হয় কাঠগড়ার আসামী। অথচ এমনটা হবার কথা ছিলনা। মাঝে দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বাদ দিলে এদেশে নারী প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায়নের প্রায় তিন দশক। তাহলে নারী অধিকার তথা নারীর প্রতি বৈষম্যেমূলক হেন অবস্থার কারণ কী?
বাংলাদেশের নারীকে অবস্থানহীন, মর্যাদাহীন জীবন কাটাতে হয়। যৌতুকের বিরুদ্ধে বিল পাশে হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু এই অপপ্রথার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ মেয়েদের খুবেই সীমিত। সে সরাসরি আইনের দ্বারস্থ হতে পারে না। তাকে আগে অনুমোদন চাইতে হবে প্রথম শ্রেনীর অফিসারের কাছে। সেটা পাবার পরই একমাত্র ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাবার ছাড়পত্র মেলে। বিয়ের ব্যাপারে মেয়ের মতের তোয়াক্কা কেউ করে না। অথচ বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইন পাশ হয়েছে ১৯২৯ সালে। কিন্তু বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়নি। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীর প্রতি বৈষম্যের এ এক অলিখিত দলিল হয়ে আছে। একজন নারীর বেঁচে থাকার ততটুকু অধিকার আছে, যতটুকু পুরুষ তাকে দেবে।
আইসিডিডিআরবির বাংলাদেশে লিঙ্গীয় পরিচয় (জেন্ডার) এবং নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কে পুরুষের মনোভাব ও চর্চা শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামের ৮৯ ও শহরের ৮৩ শতাংশ পুরুষ মনে করেন, স্ত্রী অন্যায় কিছু করলে গায়ে হাত তোলার অধিকার আছে স্বামীর। শহরের ৫০ ও গ্রামের ৬৫ শতাংশ পুরুষ বিশ্বাস করেন, পরিবারকে রক্ষা করার জন্য নারীদের নির্যাতন সহ্য করা উচিত। অথচ জাতিসংঘের ঘোষণায় বলা হয়েছে, 'নারীর প্রতি বৈষ্যমমূলক আচরণ মানব মর্যাদা এবং পরিবার ও সমাজ কল্যাণের পরিপন্থী।'
অর্থনৈতিক সমতা,রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্যতার ভিত্তিতে নারী পুরুষ সমতার সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও এখনো এদেশের নারীর সাফল্যের পথে বাঁধা হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্মকে নারীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে এদেশের মেয়েদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে।
নারী পুরুষের সঙ্গে দেশের ও জনজীবনের সবর্ত্র সমানাধিকার ভোগ করবে, শাসনতান্ত্রিক এই অধিকার থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের নারী এখন ক্রমবর্ধমান ভায়োলেন্সের শিকার।অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে ভায়ালেন্সের পরিনতি মৃত্যু। সভ্যতার শুরু থেকে নারী নির্যাতন শুরু হয়েছে যা বিংশ শতাব্দীতেও এসে থেমে যায়নি।আদি যুগে শিকারজীবী জীবন থেকে কৃষিজীবী জীবনে প্রবেশের সময় পুরুষ শাসনদন্ড হাতে নিয়ে নেয়।তারপর থেকে যুগে যুগে নারী নির্যাতন চলে আসছে।এ নির্যাতন বাংলাদেশে সবচাইতে বেশী একথা হয়তো বলা যাবে না, কিন্তু অনেক দেশের তুলনায় যথেষ্ট বেশী তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বাংলাদেশের বেশীরভাগ নারী এবং মেয়েরা নানা মাত্রায় লিঙ্গ বৈষ্যমের শিকার।বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে চলতি ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে কমপক্ষে ২৩৫ জন নারীকে তাদের স্বামী বা স্বামীর বাড়ির লোকদের নির্যাতনে প্রাণ দিতে হয়েছে।পাশ্চাত্য দেশে নারী নির্যাতন হয়তো স্বচ্ছল জীবনের বিলাসিতা। অন্যদিকে বাংলাদেশে নারী নির্যাতন তথা কর্মক্ষেত্র সহ সকল অবস্থানে নারী হ্যারেসমেন্ট পুরুষতান্ত্রিক উগ্র মনোভাবের পরিচায়ক। এদেশে একজন নারী যেমন মানুষ হিসাবে কোন স্বীকৃতি পায়নি তেমনি পায়নি শ্রমশক্তির স্বীকৃতি। আমাদের সমাজে এরকমও অভিযোগ করা হয় নারী কর্মবিমুখ। ঘরের কাজের কোন বিনিময় মূল্য নেই তাই তাদের কাজকে নন-প্রোডাক্টিভ কাজ হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু অর্থনীতিবিদ ড. আব্দুল্লাহ ফারুক তাঁর এক সমীক্ষায় ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, 'বাংলাদেশের গ্রামের মেয়েরা প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা উৎপাদনমুখী কাজ করে যেখানে পুরুষরা করে মাত্র ১০ থেকে ১১ ঘন্টা।
এদেশের নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি বুঝতে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও প্রথম আলো একটি অনলাইন জরীপ করে,তাতে ৭৯ শতাংশ মানুষ অনলাইনে হয়রানির শিকার,যার মধ্যে ৫৩ শতাংশ নারী।
গত বছরের ১৬ নভেম্বর পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন নামে একটি ফেসবুক পেজ চালু করা হয়।তার দুইদিনের মধ্যে ৬৯১ টি অভিযোগ জমা পরেছে।পুলিশ সদর দফতরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের তথ্যমতে,সেবা চালুর এক সাপ্তাহের মধ্যে ১ হাজার ৯১৬ জন নারী তাদের সাথে সংঘটিত অপরাধের প্রতিকার চেয়ে অভিযোগ করেন।যারা অভিযোগ করেন তারা সবাই কিশোরী ও তরুণী।
প্রতিদিন অসংখ্য মেয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে,নিহত হচ্ছে,পঙ্গু হয়ে জীবন কাটাচ্ছে,এর অধিকাংশ ঘটনা আমাদের অজানা রয়ে যায়।দু একটি ছিটকে এসে খবরের পাতায় স্থান করে নেয়। চলতি বছরের মাত্র নয় মাসে ২৩৫ জন নারীকে তাদের স্বামীর হাতে অথবা স্বামীর পরিবারের লোকের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজনের বিবাহের বয়স হয়েছিল মাত্র একমাস। হাতের মেহেদী ও চোখ স্বামী সংসারের স্বপ্ন মিশতে না মিশতেই তাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। যশোরের অভয়নগরের হীরা বেগমের বিয়ে হয়েছিল বিল্লাল নামের একজনের সাথে, বিয়ের পর থেকেই বিল্লাল হীরাকে নিয়ে ভারতে যেতে চেয়েছিল। হীরার অপরাধ সে বাবা মাকে ছেড়ে সদ্য বিবাহিত স্বামীর সাথে ভারতে যেতে আপত্তি জানায়। এ নিয়ে প্রায় স্বামী স্ত্রীর কথা-কাটাকাটি হতো। অবশেষে পাষণ্ড স্বামী হীরা বেগমের গায়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগিয়ে হত্যা করেন। জামালপুরের মেলনন্দহ উপজেলার মেয়ে দোলনা আক্তার আশুলিয়া একটি পোষাককারখানায় কাজ করতেন। জানা যায় তিন মাস আগে তালাক দেওয়া স্বামী প্রতিশোধ নিতে দোলনার গায়ে অ্যাসিড ছুড়ে মারেন। এভাবেই বিংশ শতাব্দীতে এসেও স্বামী ও স্বামীর বাড়ির লোকদের দ্বারা ক্রমবর্ধমান নির্যাতনের স্বীকার হয়ে প্রাণ দিচ্ছে বাংলাদেশের নারী এবং এসব ঘটনা থেকে বুঝা যায় যে, একজন পুরুষের কাছে একজন নারী একটি পণ্যমাত্র, যাকে দখলে রাখা না গেলে নিঃশেষ করে ফেলাই পুরুষের কাছে শ্রেয় বলে মনে হয়।
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন,পুরুষের সমকতা অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি কখনো পুরুষকে ছোট করে দেখেননি। তাই তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা মূল্য যাহা, আমাদের মূল্য তাহাই।’ তার মতে, প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে নারী-পুরুষের সমতা অনস্বীকার্য। সেক্ষেত্রে নারীকে শুধুমাত্র লিঙ্গ ভিত্তিক বৈষম্যের মধ্যে ফেলে সমাজের একটি উন্নয়নের চাকা বিকল করে রাখা হচ্ছে। ধর্মের নামে, সমাজ ব্যবস্থার নামে নারীকে বন্ধি করে রাখা হচ্ছে। নারীকে মানুষ হিসাবে দেখতে হবে।সেক্ষত্রে পুরুষদের যেমন পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ত্যাগ করতে হবে।তেমনি নারীদেরকেও আপন সত্তা ও নারীত্বের স্বকীয়তা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
জাহানুর রহমান খোকন
কুড়িগ্রাম
2 মন্তব্যসমূহ
ভাই, আমার বুকে আসেন। কুড়িগ্রামের ভাই আমার এদন কইরা ভাবে, এইটা জানিয়াই মোর ভালা লাগিছে। এগিয়ে চলো, দূর দিগন্তে---
উত্তরমুছুনলেখাটি ভাল লাগল। কিন্তু কে যেন বলেছিল "ইহাদের অতি লোভী মনে, এক পেয়ে খুশি নয়, যাচে বহুজন" তার কথা বললেন না যে। কি কারণ?
উত্তরমুছুনমন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।