0000

গল্প || ইলতুৎমিশ || জাহানুর রহমান খোকন


একটা সময় সমুদ্র কাহিনি লেখা হতো ঢেউয়ের রঙে আর মেঘ-বায়ুর সুরে। সেরকম একটি রোববারের বিকেলে, বঙ্গোপসাগরের নীল আয়নায় যখন সূর্য হেলে পড়ছিল, তখনই একটি ছোট্ট হৃদয় পৃথিবীতে তার প্রথম শ্বাস নিল। ইলতুৎমিশ। নামটা এসেছে বহু দূরের তুর্কি ভাষা থেকে; যার অর্থ ‘রাজ্য রক্ষক’। সে এক বিরাট কাহিনি। সাগরে মাছ শিকার করতে যাওয়া জেলেদের মুখে মুখে যে গল্প মহাকাশ অবধি ডালপালা ছড়িয়েছে।

ইলতুৎমিশের মা ছিল এক প্রবল শক্তিধর এবং কোমল হৃদয়ের ডলফিন। নাম ইয়ানো-ইলতুৎমিশ। তিনি ভারত মহাসাগরে বসবাস করতেন। ইয়ানো-ইলতুৎমিশ বহু সাগর মহাসাগর পেরিয়ে বিশ্বমণ্ডল ভ্রমণ করেছেন। সাগর জলের নানান প্রাণীর সঙ্গে তাঁর সখ্য রয়েছে। ইলতুৎমিশের জন্মের দিন বিভিন্ন মহাসাগর থেকে ছোট প্রাণীরা মেঘের মতো এসেছিল তাকে দেখতে। দিনটি সমুদ্র-উৎসবের মতো ছিল। কিন্তু যখন ইলতুৎমিশ নয় মাসের ছোট্ট গড়নের প্রাণী, যখন তাঁর মা ইয়ানো তাকে প্রথমবারে বঙ্গোপসাগরের সাদুপানি-মিশ্র মোহনায় নিলা জলে নিয়ে আসে। সেই মোহনায় যেখানে নদীর পানির উজান স্রোত বঙ্গোপসাগরের লীলা ছুঁয়ে যায়।

এক.

ইলতুৎমিশ এখন নয় মাস বয়সের ছোট্ট গড়নের ডলফিন শাবক। সাধারণত এই বয়সের ডলফিন শাবক মায়ের আশেপাশে থেকে সাঁতার শিখে। এসময় তাঁরা মায়ের কাছ থেকে সাঁতারের কৌশল, শিকার ধরা, লাফানো ইত্যাদি শিখে থাকে। যাকে বলে ‘echelon swimming’। শিশুর শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি ও শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য মা ডলফিনরা শাবককে নিরাপদ কোন স্থানে নিয়ে যান। ইলতুৎমিশের মা ইয়ানো বঙ্গোপসাগরের বড় বড় জাহাজের ঢেউ ও উত্তাল সমুদ্রের ঝাঁপটা থেকে রক্ষা করতে মোহনা অঞ্চলে নিয়ে আসেন। মোহনায় এসে ইলতুৎমিশ প্রথমে শুধু মা’র সঙ্গে খেলার মতো করে লাফালাফি করত। নদী ও সাগরের মোহনায় ভেসে উঠা বুদ্‌বুদ নিয়ে নাচানাচি, স্রোতের সঙ্গে খেলা, ছোট মাছদের সাথে দৌড়া-দৌড়ি করে সময় কাটিয়ে দিতো। ছোট্ট শাবকের এসব খেলাধুলা দেখে ইয়ানো হাসত এবং তার ইকোলোকেশন শব্দ কণ্ঠে ইলতুৎমিশকে সঙ্গতিশীলতা শেখাতো। কখন কোন দিকে স্রোত, কোথায় গভীরতা বদলে গেছে, কোন জায়গায় ছায়া পড়ে আছে সেসব সম্পর্কে উপলব্ধি করতে শেখাতো। ইলতুৎমিশের এসব শেখার থেকে কৌতূহলই বেশি। সে জানতে চেয়েছিল, কেন এমন ভিন্ন ভিন্ন জল রং? ইয়ানো সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলত ‘দেখো, সামনে নদীর পানি মৃদু মিষ্টি। সমুদ্রটা নোনা; এখানে দুইটি পানির মিশ্রণ হয়, এটাকে বলে মোহনা। এখানে মাছেরা বিশ্রাম নেয়।’ ইলতুৎমিশ সেই মিশ্র জলে ছোট ছোট মাছদের সঙ্গে লুকোচুরি, সামুদ্রিক কাঁকড়ার সঙ্গেই খেলায় মেতে উঠে। এসবই যেন তাঁর নতুন পৃথিবী।

দুই.

ইলতুৎমিশ সামুদ্রিক কাঁকড়া আর ছোট ছোট মাছদের সাথে যখন খেলছিল। ওই সময় মা ইয়ানো একবার মোহনার কাছাকাছি চলে আসে। ইয়ানো বহুবছর পর মিঠাপানিতে আসলো। সে একবার ভূষ করে পানির উপরে গলা তুলে শ্বাস নেয়। এসময় সে দেখলো মোহনার খুব কাছেই একঝাঁক বক পাখি ডানা মেলে বিশ্রাম নিচ্ছে। নোনা পানির উজান স্রোতে কচু ফুল ভেসে আসছে। সেখানে মরা কোন পশুর শরীরকে কেন্দ্র করে কাকদের মেলা বসেছে। দূরে তেলবাহী একটি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। এসব জাহাজে করে তেল আসে আর ছোট ছোট জাহাজে করে সেই তেল বন্দর হয়ে মানুষের কাছে চলে যায়। ইয়ানো ভাবে উন্নয়নের নামে এত জ্বালানি পুড়িয়ে মানুষ আসলে কী করে?

এসব মোহনার কাছে কচু ফুল আর পাখিদের মেলা ছাড়াও আরও কিছু অদ্ভুত জিনিস দেখা যেতো। সেটা হলো প্লাস্টিক ও বোতল। মানুষের ব্যবহৃত এসব প্লাস্টিকজাত বস্তু উজানের স্রোতে ভেসে আসে আর মোহনায় জমে নদী ও সাগরকে ভাগাড় করে তোলে। ইলতুৎমিশ প্রথমে এই প্লাস্টিকের জিনিস গুলোকে খেলনা মনে করতো। একদিন সে আর লাল কাঁকড়ার দুই শাবক মিলে একটা প্লাস্টিক ব্যাগের ভেতরে ঢুকে লুকোচুরি খেলছিল। ইয়ানো তাকে বলেছিল, শোনো বাচ্চা ইলতুৎমিশ, এগুলো মানুষের ব্যবহৃত জিনিস। মানুষ থেকে যতই বেশি দূরত্ব রাখবে, ততই ভালো। আজ কৌতূহল থেকে দেখছো, খেলছো সেটা ঠিক আছে। কিন্তু মানুষ হতে সাবধান। ছোট্ট ইলতুৎমিশ এসব প্লাস্টিকের ভেতরে খেলা ঘর পেয়ে খুশি ছিল। মায়ের উপদেশ সে খেয়াল করেনি। ইলতুৎমিশ প্লাস্টিকের ভেতরে ঢুকে খেলছিল।

হঠাৎই ঢেউয়ের বুকে একটা অদ্ভুত দাগ ছড়িয়ে পড়ে। চকচকে কালো সেই দাগ, ঝাবরানো তেলের বুদ্‌বুদ চারদিকে মিশে যায়। তেলপদার্থ জলে ছড়িয়ে পড়লে সেটা পাখি-ডানার মতো সিলক তৈরি করে। এসব দেখে ইয়ানো ভয় পায়। কারণ সে জানত এটা বিপদ।

তিন.

ইলতুৎমিশ তখনো প্লাস্টিক ব্যাগে লুকোচুরি খেলছিল। কালচে, ঘন ও দুর্গন্ধযুক্ত তেল স্রোতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তাকে ঘিরে ফেলে। হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। ইয়ানো অন্ধকার ভেদ করে ইকোলোকেশন শব্দযন্ত্র ব্যবহার করে ডাকে ইলতুৎমিশ! ইলতুৎমিশ!! কিন্তু ইয়ানোর সেই ডাক একটা সরু সিগন্যাল হয়ে ধ্বনিত হয়। পলিথিনে আটকে পড়া ইলতুৎমিশের পথ চিনে সেই আওয়াজ পৌঁছায় না। ইয়ানো কাঁপতে থাকে; সে গুমরে উঠে। ইকোলোকেশনের মাধ্যমে শেষবারের মতো সে ডাক দেয়, ইলতুৎমিশ। একবার, দু’বার, বারংবার। কিন্তু তেল ঢেকে যাওয়া স্রোত শব্দকে এবং ইয়ানোর শরীরকে দুর্বল করে দেয়। এদিকে এক সপ্তাহ যায়, দু’সপ্তাহ যায়। ইলতুৎমিশ প্লাস্টিকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। তাঁর মা, মা ডাক ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে। ইয়ানো পেছনে স্রোত ধরতে থাকে। সে আকাশে স্ত্রী পাখিদের কাছে সাহায্য চায়, কাছাকাছি থাকা কচ্ছপ, সামুদ্রিক প্রাণী ও মানুষের কাছে সংকেত দেয়। কিন্তু একটি বড় তেলবাহী জাহাজ যেখানে কাজ করে সেখানে মানুষজন ছোট ছোট অনেক বিষয় নজরে আনে না। তারা বুঝতেই পারে না যে মোহনায় কী ঘটছে।

একদিন গ্রামের ছেলে রুমি মোহনায় মাছ ধরতে গিয়ে দেখে নদীতে তেল ভাসছে। নদীতে তেল দেখে রুমি চিৎকার করে এলাকাবাসীকে ডাকতে থাকে। এলাকাবাসী মোহনায় এসে তেল সংগ্রহ করার সময় প্লাস্টিকের ব্যাগে আটকানো ইলতুৎমিশকে দেখতে পায়। পরে ডা. নীলকে খবর দেওয়া হয়। ডা. নীল ছিল রুমির স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক। তিনি দ্রুত কয়েকজন গ্রামবাসী ও মৎস্যজীবীর সাহায্য নিয়ে ছোট নৌকা বানালেন; সেই নৌকা নিয়ে ছুটে গেলেন মোহনায়। ইয়ানো এসে তাদের পথ দেখালো। পলিথিন ও তেল দিয়ে শিশু ইলতুৎমিশের দেহ আটকিয়ে আছে। জেলেরা প্লাস্টিক টানতে চেষ্টা করে। কিন্তু প্লাস্টিক ভেঙে গেলে ইলতুৎমিশের দেহ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে ডা. নীল জানায়।

রুমি চোখে পানি নিয়ে এগিয়ে আসে। সে প্লাস্টিকটা কেটে ফেলার জন্য একটি ধারালো ছুরি নিয়ে আসে। ইলতুৎমিশের ক্ষতি না করে প্লাস্টিক কাটার সকল চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্লাস্টিক জড়ানো ও তেলের সংমিশ্রণের ফলে ইলতুৎমিশের শরীর শক্ত হয়ে ছিল। প্রকৃতি ও মানুষের অদ্ভুত এক রহস্যে সেদিন ডা. নীল, স্কুল ছাত্র রুমি ও জেলেদের সব চেষ্টা সার্থক হতে পারেনি। কয়েক সপ্তাহে খাবার না পেয়ে ইলতুৎমিশ দুর্বল হয়ে পড়ে। একসময় ক্ষুধায় আমাদের ছোট রাজ্য রক্ষকের মৃত্যু ঘটে। ডা. নীল ইলতুৎমিশ এর শরীর মোহনায় ভাসিয়ে দেন। এসময় জেলে বউরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। ইয়ানো শেষবার সন্তানের দেহ স্নেহে জড়িয়ে ধরেন এবং ইলতুৎমিশের শরীরকে জলের উপরে ভাসিয়ে মোহনায় কয়েক চক্কর দেয়। পরে ধীর ও কম্পমান শিস দিতে দিতে মোহনায় ডুব দেয়।

চার.

ইলতুৎমিশের দেহ নিয়ে পানিতে ডুব দেওয়ার পর মা ইয়ানো ডলফিন আর মুখ দেখায়নি। তরুণ শিক্ষক ডা. নীল চিরাচরিত ভাষায় সমস্ত গ্রামবাসীকে বুঝালেন তেল পানি জলে ভেসে গিয়ে শ্বাসনালি হয়ে মাছের শরীরে প্রবেশ করে। এতে মাছ মারা যায়। প্লাস্টিক তেলের সাথে মিশে ছোট কণায় ভেঙে যায়। মাইক্রোপ্লাস্টিক হয়। এগুলো মাছ ও কচ্ছপ খেয়ে মানবের খাবারের চেইনে উঠে আসে। আজ ইলতুৎমিশ আমাদের শেখালো, আমাদের অসতর্কতায় সৃষ্ট প্রতিটি ছোট কাজ কীভাবে বড় প্রভাব ফেলে। গ্রামবাসীদের মধ্যে পরিবর্তনের ঢেউ লাগলো। ইলতুৎমিশের স্মৃতিতে গ্রামবাসীরা শুরু করলো মোহনা পরিষ্কার অভিযান। মৎস্যজীবীরা, স্কুলের শিক্ষকরা, মহিলা সমিতি সবাই মিলে প্লাস্টিক সংগ্রহ করল। ডা. নীল সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের সেমিনার করলেন। রুমির নেতৃত্বে ‘ইলতুৎমিশ মেলা’ নামে একটি স্থানীয় জলবায়ু সংগঠন গড়ে উঠলো। তাঁরা মোহনায় 'নো প্লাস্টিক ডে' পালন করল।

ইয়ানো এখনো তাঁর পুত্রকে ভুলতে পারেনি। সে প্রতিদিন মোহনায় এসে নিঃশব্দে গান গাইত, ইকোলোকেশন সুরে ইলতুৎমিশের নাম ধরে ডাকতো। একদিন এক বৃদ্ধ তিমি মোহনায় এলো। যার নাম ছিল দরিয়া। ইলতুৎমিশের সমুদ্রযাত্রা সাঁতার অনুষ্ঠানেও দরিয়া এসেছিল। দরিয়া ছিল ইয়ানোর পুরোনো বন্ধু। সে ইয়ানোকে ইলতুৎমিশের মৃত্যুর কারণ হিসাবে মানুষের ব্যবহৃত প্লাস্টিককে দায়ী করলো। সে বুঝালো ছোট্ট ইলতুৎমিশ নিজের জীবন দিয়ে হাজারো প্রাণের রক্ষক হয়ে উঠেছে। তার নাম এখন কেবল তোমার একার নয়। এটা সাগরের সকল জীবের কাছে এক পরিচিত নাম। ইয়ানো প্রথমে অনিশ্চিত ছিল, কিন্তু পরে বুঝল, ইলতুৎমিশের স্মৃতি মানুষকে কতটা বদলে দিয়েছে।

পাঁচ.

ইলতুৎমিশ একরাত সূর্যাস্তের পরে বঙ্গোপসাগরের নীল সরলীতে আলোর ঝিলিক হয়ে হাজির হল। সে আর শারীরিক দেহে নেই। কিন্তু তার ইকোলোকেশন থেকে আসা সুর এখন সারা মোহনাকে স্পর্শ করে। এক ধরনের কম্পন তৈরি করে। সাগরপাড়ের মৎস্যজীবীরা বলাবলি শুরু করলো রাতের কোনো এক সময় তারা ছোট একটা সাদা-চামড়ার আভা ঢেউয়ের উপর নেচে উঠতে দেখেছে। ইলতুৎমিশ ফিরে এসেছে।

ইলতুৎমিশের আত্মা একটা নীল বুদবুদে পরিণত হয়ে মোহনায় ছড়িয়ে পড়ল। সেই বুদবুদগুলো ধীরে ধীরে প্লাস্টিককে ঘিরে ফুল হয়ে ফুটে উঠলো। সমুদ্র জীব ও মানুষের মাঝে নতুন বন্ধুত্ব হলো। এভাবে বছর গড়াল, ইলতুৎমিশের নাম সাগরপাড়ের জেলেদের মুখেমুখে গল্প হয়ে রইলো।

এবং ইয়ানো? তিনি এখন বয়সে বুড়ো হয়ে হয়ে গেছেন। কিন্তু প্রতিদিনই সে মোহনায় এসে ডলফিনদের সাথে খেলতে থাকেন। লাল কাঁকড়ার বাচ্চা আর সামুদ্রিক ছোট ছট মাছদের শিশুদের সাথে তাঁর দিনের সময় কেটে যায়। আর রাতে ইলতুৎমিশের স্মৃতিতে মোহনায় গলা উঁচু করে একটুখানি গান গাইতেন। সেই গানে শুরুতে কষ্ট, পরে গৌরব ফুটে উঠতো। ইলতুৎমিশের জন্য গর্ব করতে করতে ইয়ানো গান থামিয়ে চুপ হয়ে থাকতেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Back To Top