0000

সুরসুরিতে শিহরণ || জাহানুর রহমান খোকন

ছবি- সংগৃহীত


এক.

বিপত্নীক বাচ্চু মিয়া তারাগঞ্জের তামাকের বড় ব্যবসায়ী।স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিন কন্যা ও একমাত্র ছোট ছেলে সফিকের দিকে চেয়ে আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। যদিও নিন্দুকেরা বলাকওয়া করেন টাকার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া বাচ্চু মিয়ার কাছে স্ত্রী সন্তানের কোন মূল্য নেই।লোকমুখে শুনা যায় ভাটিদেশে থেকে ক্ষেপ ফেরত আসার পর  বাচ্চু মিয়া তার টাকা বাঁশের তালাইয়ে করে রোদে শুকাতে দিতেন। আবার কেউ কেউ কানাকানি করে গুজব ছড়িয়েছে বাচ্চু মিয়া রাতে টাকার কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমান। তাইতো ঘর সংসারের প্রতি তার উদাসীনতা। স্ত্রী সালেহা বেগমের মৃত্যুর পর বাচ্চু মিয়া একাই তিন কন্যাকে লালন পালন করে উপযুক্ত ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে সফিকে এসএসসি পাশ করিয়েছেন। বাচ্চু মিয়া চান ছেলে পড়াশুনার পাশাপাশি ব্যবসায় বসুক।কিন্তু ছেলের  ব্যবসার প্রতি কোন আগ্রহ নেই। সারা দিন শুধু ক্রিকেট খেলা নিয়েই মেতে থাকে।ক্রিকেট তার ধ্যানজ্ঞান। গত বছর কলেজের বার্ষিক পরিক্ষায় ফলাফল খারাপ করেছিল।কলেজ থেকে অভিভাবক  কল করা হয়েছিল। বাচ্চু মিয়া তার বাল্যবন্ধু এবং তার তামাক কারখানার ম্যানেজার সাজু শেখের সাথে পরামর্শ করেন ছেলেকে কিভাবে ব্যবসায়ী করা যায়।ছেলের যেহেতু পড়াশুনায় মনোযোগ নাই, তাই বাচ্চু মিয়া বেঁচে থাকতেই তাকে ব্যবসার খুটিনাটি শিখাতে চায়। সাজু শেখ কানমন্ত্র দিতে থাকেন, ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দাও,বিয়ে দিলে ছেলে সংসারী হবে, ঘারে লাঙ্গল পরলে গরুর হালে চলা ছাড়া কোন উপায় নাই। 

-কিন্তু ভাল মেয়ে কোথায় পাবো বাচ্চু মিয়ার এমন প্রশ্নে সাজু শেখ বলেন, আমাদের বন্ধু ভেলু ব্যাপারী তার একটি বিয়ের উপযুক্ত সুন্দরী মেয়ে আছে। তাছাড়া ভেলু ব্যাপারীর সাথে তোমার দীর্ঘদিনের যে দ্বন্দ্ব ছেলে মেয়েদের বিয়ের মধ্যদিয়ে সে দ্বন্দ্বেরও অবসান ঘটানো যাবে বলে সাজু শেখ উল্লেখ করেন।

-ভেলু ব্যাপারী কি এ প্রস্তাব মেনে নিবে?

চাটুকার সাজু শেখ বলেন, আমাদের ছেলে সফিক তো খারাপ নয়,এই বয়সে সব ছেলে-মেয়েদের মাথায় একটু আধটু খেলার নেশা থাকে, তাছাড়া তোমার যে সম্পত্তি সেটার একমাত্র উত্তরসূরী সফিক এটাও কমকথা নয়। ভেলু ব্যাপারীকে বুঝানোর দায়িত্বটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও। সাজু শেখের কথায় আশ্বস্ত হয়ে বাচ্চু মিয়া তারাগঞ্জের বিখ্যাত মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে মিষ্টি কিনে সাজুর মাধ্যমে ভেলু ব্যাপারীর বাসায় পাঠিয়ে দেন।

ভেলু ব্যাপারীর বাসা থেকে ফিরে সন্ধ্যায় সাজু শেখ গদিতে হাজির হয়ে ফ্যাক্টরির সকল শ্রমিকদের মিষ্টান্ন বিতরণ করা শুরু করেছেন।আর সকলকে রাষ্ট্র করে প্রচার করে বলা শুরু করেছে যে,ভেলু ব্যাপারীর সাথে আমাদের মালিকের বিরোধ আজ থেকে শেষ। দুই বন্ধু এখন বিয়াই হতে চলেছে। শ্রমকদের কেউ কেই খুশি হলেও দুই একজন বলাবলি করছে ভেলু ব্যাপারী অসৎ।চাটুকার ম্যানেজার সাজু শেখ আর ভেলু ব্যাপারী মিলে নিশ্চয়ই আমাদের মালিকের বিরুদ্ধে কোন স্বরযন্ত্র করতেছে। কিন্তু কেউ প্রকাশে ম্যানেজারের বিপক্ষে কোন কথা না বলে মিষ্টি নিয়ে কাজে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর বাচ্চু মিয়া গদিতে আসলে সাজু শেখ জানালো ভেলু ব্যাপারী তো এ প্রস্তাবে খুবেই খুশি হয়েছেন।কিন্তু একটি ছোট্ট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভেলু ব্যাপারীর বৌ।

-ভেলুর স্ত্রী রাজি হয়নি? মুখের উপর না করে দিলো, কিন্তু তোমাকে যে দেখলাম কারখানার সকল শ্রমিককে মিষ্টি খাওয়াতে! 

তুমি সব কথা না শুনেই এতো উত্তেজিত হও কেন? তোমার বয়স হচ্ছে। এ সময়ে তোমার স্থির থাকা দরকার। আগে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনো, ভেলু ব্যাপারীর স্ত্রীর চাওয়া তুমি তোমার ছেলে ও ছেল বউয়ের নামে তোমার অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দাও। আমি তাকে বুঝালাম তোমার একমাত্র ছেলে সফিক,তোমার অবর্তমানে সমস্ত সম্পদের মালিক সে কিন্তু স্ত্রী লোকটিকে কোনমতেও বুঝাতে পারলাম না। শেষে তার কথাতেই রাজি হয়ে এসেছি।এখন বাকীটা তোমার মতামত ও আমার সম্মান।

সাজু শেখের কথা শুনে বাচ্চু মিয়া হাসেন। তুমি আমার বাল্যবন্ধু।তোমার কথাই আমার কথা।তুমি দিনতারিখ ঠিক করে সকল ব্যবস্থা করো। বাচ্চু মিয়ার কথা শুনে সাজু শেখ বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করলো।একদিন মহাধুমধামে বিয়ের দাওয়াত ও আয়োজন হতে লাগলো কিন্তু বিয়েরদিন সকালে সফিক কেনাকাটার কথা বলে শহরর গেলেও বেলা গড়িয়ে বিকেল হলেও সফিক বাসায় ফিরলো না।পাত্রী পক্ষের বাসা থেকে বারবার কল করা করে অবশেষে ভেলু ব্যাপারী নিজেই বাচ্চু মিয়ার বাড়িতে আসলেন।এসে সবিস্তারে ঘটনা শুনে বন্ধুকে বললেন, বাচ্চু তোমার ছেলের হয়তো অন্য কোন মেয়েকে পছন্দ ছিল যেকারণে সে ঐ মেয়ের সাথে পালিয়েছে। চাটুকার সাজু শেখ বলে উঠলো, একদিক থেকে ভালই হলো বিয়ের আগেই ঘটনাটা ঘটেছে। মেয়েটির বিয়ে হলে তো দ্বিতীয়া হয়ে যেতো।সাজু শেখের কথায় প্রতিবাদ করলো ভেলু ব্যাপারী কিন্তু আমার মেয়ের মনটা তো ভেঙ্গে গেল,তার কি হবে।তাকে তো আর এরপর কোন ভাল ঘরে বিয়ে দিতে পারবোনা।

এতোক্ষণ পরে বাচ্চু মিয়া মুখ খুললেন, ছেলে পালিয়ে যাওয়ায় আমি নিজেই লজ্জিত। আর তোমার মেয়ের সম্মানের বিষয়টি নিয়ে আমি নিজেও এতোক্ষণ ভাবতেছিলাম। তোমার মেয়ে মানে আমারও মেয়ে। আমি নিজেই তাকে উপযুক্ত ভাল কোন পরিবারে বিবাহ দিবো।

সাজু শেখ উস্কানি দেয় ভেলু ব্যাপারীর মেয়ে ভানু মতির নামে তুমি স্থায়ী কিছু সম্পত্তি লিখে দাও।ভানু মতি তো আর অন্য কেউ নয়, তোমার মেয়ের মতোই। অনিচ্ছা স্বত্তেও বাচ্চু মিয়া ভেলু ব্যাপারীর মেয়ের নামে তার ব্যবসার সিকিআনা অংশীদার করে লিখে দিতে বাধ্য হন। ভেলু ব্যাপারীর সহজে ছাড়ার লোক নয়,যেকোন উপায়ে টাকা সে আদায় করেই ছাড়তো তাই বন্ধুত্ব ও সম্মান বাচাতে মুখে মেকি হাসি হেসে বলে, তা ঠিক মতি তো আমার মেয়ের মতোই।আর মুখে দাঁত খিচমিচ করে ছেলের উদ্দেশ্যে ভৎসনা করে কাপুরুষ। হ্যাঁ, কাপুরষ বটে, নাহলে বিয়ের রাতে কেউ পালিয়ে যায়।?।


দুই.

শীতের সকালে বাচ্চু মিয়া গদীতে বসে তামাক সেবন করছেন। এমন সময় ভেলু ব্যাপারী ও সাজু শেখ গ্রামের কিছু তরুণ ছেলে বুড়া নিয়ে হাজির হলেন। তারা সকলে বাচ্চু মিয়ার কাছে আবদার করলো শীতের দিনে এলাকায় একটি যাত্রা গানের আয়োজন করতে,যেখানে বাচ্চু মিয়াকে সত্ত্বাধিকারী থাকতে হবে। আর যাই হোক গ্রামের হাজার গরীব মানুষের বিনোদনের বিষয়টা এলাকার মাথা হিসাবে তো বাচ্চু মিয়াকে দেখা উচিত। তাছাড়া যাত্রা পালা আনলে যে এসব চাষাভুষা লোকজন তামাক একটু বেশী খাবে সেকথা বাচ্চু মিয়ার অজানা নয়। তবুও এলাকার তরুণরা যখন বললো, আপনার এক কথা গ্রামের অন্যান্য মানুষের হাজার কথার সমান। ওসি সাবকে আপনি ছাড়া আর কে রাজি করাতে পারবে বলুন। কথাটি বাচ্চু মিয়ার ভাল লেগেছে। তিনি সবাইকে বসতে দিয়ে ওসি সাহেবকে ফোন করেন। থানার ওসি সাহেব বাচ্চু মিয়ার কাছের মানুষ। তিনি ওসি সাহেবকে ফোন করেন। তারপর ফোন রেখে সকলের উদেশ্যে বলেন, সব আপনাদের আশীর্বাদ। আপনারা আমাকে ভালবাসেন বলেই আজ আমি সামান্য তামাকের ব্যবসায়ী থেকে আজ এতোবড় বিড়ি ফ্যাক্টরীর মালিক হতে পেরেছি। শুধু মনের মধ্যে কষ্ট একটাই ছেলেটা আমাকে বুঝলো না। ছেলেটা নাজানি কোন বদ মেয়ের প্রেমে পরে কোথায় চলে গেল। মা মরা ছেলে আমার। বলতে বলতে বাচ্চু মিয়ার চোখ ছলছল করে উঠে। বদ মেয়ের পাল্লায় পরার বিষয়টা সাজু শেখের শেখানো বুলি।

এমন সময় ওসি সাব গদীতে ঢুকতে ঢুকতে বলেন, ছেলেরে নিয়া চিন্তা কইরেননা মিয়া। পোলা মানুষ বাইরে থাকলে হয় মরদ, আর মাইয়া মানুষ বাড়ির বাইরে থাকলে হয় মাগী। ছেলের চিন্তা ছাইড়া দেন। এহন চিন্তা করেন, সামনের ইলেকশন নিয়া। আমি এই থানায় থাকতেই আপনি একবার ইলেকশন করেন। চেয়ারম্যান কিভাবে বানাতে হয় হেইডা আমার উপর ছেড়ে দেন। আপনার মতো সম্পত্তি থাকলে মিয়া আমি চাকুরী ছেড়ে বাসায় গিয়ে এম.পি ইলেকশন করতাম। তয় পোলাডা আপনার সাচ্চা দিলডা বুঝলো না। যাই হোক হাতে সময় কম, আপনি ফোন দিছেন তাই চইলা আসলাম। কি কথা কইয়া ফালান।

বাচ্চু মিয়া কোন ঘোরপ্যাঁচ না করে সোজাসাপটা কাজের কথায় আসেন। ওসি সাব, এলাকার গরীব চাষাভুষা মানুষজন বায়না ধরেছে যাত্রাপালা আনবে। আপনি যদি অনুমতি দেন তবেই সেইটা সম্ভব। বুঝেন তো গরীবের বিনোদন। ওসি সাব হাসেন। ও এই কথা। তার জন্য ডেকে পাঠানোর কি আছে। বুঝেন তো এসব ব্যাপারে উপরের কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে। তবু আপনি যখন বলেছেন, আমি জেলা শহরের বড় বাবুকে রাজি করাবো। তার জন্য কিছু টাকা লাগবে। আমার সাথে আপনার বাজবে না। 

এমন সময় সাজু শেখ পাশ থেকে বলে উঠলো স্যার, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে... জুয়ার অনুমতি টা কিন্তু গোপনে আপনাকে দিতেই হবে। ওসিসাব মুচকি হেসে বলেন, আমি জানি সাজু শেখ। যাত্রাপালা শুধু গরীবের বিনোদনের জন্য নয়, তোমাদের মতো লাফাঙ্গা লোকদের বিনোদন তো লাগবে। সেগুলোও হবে,তবে তার জন্য একটু আলাদা খরচা লাগবে।

বাচ্চু মিয়ার সকাল সকাল বিনা লাভে টাকা দেওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিলনা। কিন্তু ওসি সাহেবের ইলেকশনের কথাটা তার মনে ধরেছে। তাই ওসি সাহেবকে খালি হাতে ফিরাতে চাননা। ভেলু ব্যাপারীর সাথে পরামর্শ করে নগদ বিশ হাজার টাকা বায়না দেন। 

ওসি সাব টাকা নিয়ে চলে যাওয়ার সময় আরেকবার কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে গেল শুনেন মিয়ারা, এলাকায় চেয়ারম্যান বানাতে পারলে এসব যাত্রাপালার জন্য আর আমার অনুমতি লাগবে না। আপনারাই সিদ্ধান্ত নিয়ে সব করতে পারবেন। বাচ্চু ভাইয়ের মতো মানুষ থাকতে চিন্তা কিসের। সকলে মিলে এবার এলাকায় চেয়ারম্যান করেন।

ওসির চলে যাওয়ার পর ভেলু ব্যাপারী সকলের উদেশ্যে বলেন, সত্যি তো আমাদের ইউনিয়নে বাচ্চু মিয়ার চেয়ে ধনে,জ্ঞানে যোগ্য আর কেউ কি আছে? কেন আমরা বারবার পঞ্চায়েতকে চেয়ারম্যান বানাই! এবার আর তা হতে দেওয়া যায়না। ওসি সাব নিজেই সে দায়িত্ব নিবেন। শুধু আমাদের প্রতিনিধি ঠিক করতে হবে। উপস্থিত সকলে সমবেত স্বরে বললেন, তা ঠিক। সাজু শেখ ও ভেলু ব্যাপারী উপস্থিত জনতাকে বিদায় দিয়ে বাচ্চু মিয়ার সাথে সলাপরামর্শ করতে বসেন। যদি একবার ভোটে জিতে যায় তবে পঞ্চায়েতের সেই দাপট ও প্রতি মাসে ফ্যাক্টরী থেকে পঞ্চায়েতের ছেলেদের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া ওসি সাব আপনের সাথে আছেন। বাচ্চু মিয়া, সাজু শেখ ও ভেলু ব্যাপারীকে দায়িত্ব দিলেন ইউনিয়নের সকল স্কুল শিক্ষক ও চাটুকার মাতব্বর লোকদের দাওয়াত দিতে। ভোটের রাজনীতি তার অজানা নয়। টাকা যেদিকে লোকজন সেদিকেই থাকবে। তার আগে গ্রামের সেইসকল লোকদের কিনে নেওয়া দরকার। যাদের কথা সকলে শুনবে। চেয়ারম্যান ইলেকশন তো আর একটি ওয়ার্ডের বিষয় নয়। তাই সকল ওয়ার্ডের পঞ্চায়েত বিরোধী কিছু চাটুকার লোককে গদীতে নিমন্ত্রণ করা হলো।

বাচ্চু মিয়ার ছাগলের খামার থেকে বড় বড় চারটি খাসি ধরে এনে জবাই করা হয়েছে। সন্ধ্যা নামার আগেই গদীতে মধ্যবয়সী ও যুবকদের ভীড় বেড়েই চলছে। অতি উৎসাহী কিছু লোকজন রান্নার স্থানে গিয়ে সাহায্য করতে শুরু করেছেন। বাদ মাগরীব গদীতে বাচ্চু মিয়া উপস্থিত হতেই সকলে তাদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসে পরলেন। মাস্টারমশাই জিজ্ঞাসা করলেন,বাচ্চু ভাই বিষয় কি হঠাৎ দাওয়াত দিয়ে পাঠালেন।

বাচ্চু মিয়া মুচকি হাসেন। আপনারা হলেন আমার কাছের মানুষ।আপনারা সবেই জানেন। আমি তামাকের ব্যবসা থেকে এখন ফ্যাক্টরী দিলাম। ভাবছিলাম একটা মিলাদ দিবো। কিন্তু ছেলেটা বাসা থেকে চলে যাওয়ায় সেইটা দিতে পারি নাই। দীর্ঘদিন থেকে নিজের করা ওয়াদা পালন না করতে পেরে মনবেদনায় ভুগতেছি। ভাবলাম মিলাদ দিয়ে সকলের কাছে দোয়া নেই, যদি ছেলেটা ফিরে আসে। কথাগুলো বলতে বলতে ভেলু ব্যাপারীকে ঈঙ্গিত দিলেন আসল কথা উঠাবার জন্য। বাচ্চু মিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই ভেলু ব্যাপারী মুখ খুললেন। শুনেন ভাইসব, আজ ওসি সাব গদীতে এসেছিলেন। তিনি বলেছেন এলাকায় চেয়ারম্যান বানাতে। এক পঞ্চায়েত কে আর কতবার চেয়ারম্যান করবেন। আজ যেহেতু সকলে এখানে উপস্থিত তাই এ বিষয়টাও একটু ফয়সালা হয়ে যাক। কি বলেন। ভোটের কথা উঠতেই উপস্থিত জনতার মধ্যে একধরণের গুঞ্জন উঠলো, কাকে চেয়ারম্যান করা যায়? বিগত বছরগুলোতে পঞ্চায়েত ছাড়া তো অন্য কেউ নির্বাচন করেনি। 

মাস্টারমশাই আবারো প্রশ্ন করলেন, প্রার্থীর নামটা কী?

একথায় যেন প্রত্যেকে একে অন্যের মুখের দিকে তাকালেন। এবার সকালে যাত্রাপালার প্রস্তাব নিয়ে আগত তরুণদের পক্ষ থেকে আওয়াজ পাওয়া গেল, বাচ্চু মিয়া থাকতে আর নতুন করে প্রার্থী খুঁজবার কারণ কী। সকলেই সম্মতি দিলো কিন্তু বাচ্চু মিয়া সকলের উদ্যেশ্য বললেন, শুনেন ভাইসাব। প্রার্থীর নাম নিয়ে অস্থির হওয়ার কোন দরকার নাই। আপনারা যাকে ঠিক মনে করবেন তিনিই এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হবেন। তবে এবার পঞ্চায়েত কে গদী থেকে নামাতেই হবে। এবার সমবেত জনতার মাঝে গুঞ্জন শোনা যায়, পঞ্চায়েতের বিপক্ষে যদি নির্বাচন করতেই হয় তবে তার একমাত্র যোগ্য প্রার্থী বাচ্চু মিয়া। তার না আছে সংসারের মায়া। না আছে অর্থের লোভ। এমন মানুষকেই চেয়ারম্যান করা ভাল হবে।

বাচ্চু মিয়া কাচুমাচু করে বললেন, আমার ভাই নির্বাচনের যাওয়ার কোন ইচ্ছা নাই। আপনারা যাকে যোগ্য মনে করবেন তাকে প্রতিনিধি করুন। আসুন এখন সকলে মিলে আজকের রাতের খাবার টা আমার এই গরীবের কারখানার শ্রমিকদের সাথে একসাথে খাবো। একথায় সকলে বাচ্চু মিয়ার উপর প্রসন্ন হলেন। অনেকে খাবার খেতে খেতে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললেন, পঞ্চায়েতের চেয়ে ঢের ভাল বাচ্চু মিয়া। তারকাছে ধনি গরীবের কোন ভেদাভেদ নাই। বাচ্চু মিয়াই এই ইউনিয়নের একমাত্র যোগ্য প্রার্থী।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাচ্চু মিয়া আবারো মুরুব্বিদের উদ্যশ্যে বললেন, আপনারা চাইলে আমি নির্বাচন করবো। তবে আমার একার পক্ষে তো নির্বাচনে জিতা সম্ভব নয়। আপনারা পাশে থাকলেই আমি দাঁড়াবো। মুরুব্বিরা ঢেকুর তুলে বাচ্চু মিয়াকে আশীর্বাদ  করে বললো, তোমার মতো যোগ্য ও সৎ প্রার্থী এই ইউনিয়নে আর একটিও নেই। তুমি দাঁড়ায় যাও। আমরা পাশে আছি। চাটুকার কিছু লোক ও তরুণ ছেলেরা শ্লোগান ধরলো। ওসি সাহেব তার টীম নিয়ে এসেছেন দাওয়াত খেতে। সাথে তিনি ফুলের ডালা নিয়ে এসেছেন শুভেচ্ছা জানাতে। ভাইসাব, জনগণের উপর আস্থা রাখুন। ধরে নেন চেয়ারম্যান হিসাবে আপনাকে আমি প্রথম শুভেচ্ছা জানালাম। আপনি শুধু এখন কাজ করে যান।আমি আছি। আপনি শুধু খরচের খাতাটা খোলা রাখবেন।


তিন.

দিন গড়িয়ে যাচ্ছে, ভোটের দিন ঘনিয়ে আসছে। ওসি সাহেব কয়েক দফায় লোক পাঠিয়ে টাকা নিয়ে গেছেন। সকল ওয়ার্ডের মেম্বারদের পোস্টার, ব্যানার খরচ দিতে দিতে বাচ্চু মিয়ার নগদ অর্থ সব শেষ। এদিকে নির্বাচন উপলক্ষে  বিড়ি কারখানায় উৎপাদিত সকল বিড়ি চলে যাচ্ছে বিনা পয়সায় ভোটারদের পকেটে। তাই সাজু শেখের কথায় ছাগলের খামারটা বিক্রি করে দিতে হয়েছে। বাচ্চু মিয়ার মনে জিদ চেপে বসেছে। মাঠে যখন নেমেছে এর শেষ দেখে ছাড়বে। কিন্তু নির্বাচনের দিনক্ষণ যতোই ঘনিয়ে আসছে ততোই বাচ্চু মিয়ার দলে লোকসমাগম কমে যাওয়া শুরু করেছে। পঞ্চায়েত বংশগত রাজনৈতিক পরিবারের লোক। সে লোকজনে বাজারে ঘাটে হোটেল ফ্রি করে না দিয়ে ভোটের আগের রাতে প্রত্যেক ভোটারকে নগদ টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে। তবুও ভোটকেন্দ্রে চলছে পঞ্চায়েত ও বাচ্চু মিয়ার ভোটের লড়াই। ভোটেরদিন কেন্দ্র ঘুরে এসে সাজু শেখ জানালো সমানে সমান ভোট পরতেছে। এখন কোন কারণে যদি একটি কেন্দ্রে পঞ্চায়েত জিতে যায় তবে সে চেয়ারম্যান। বাচ্চু মিয়া ওসি সাহেবের সাথে পরামর্শ করেন। ভেলু ব্যাপারী ও সাজু শেখ তৈয়ব মেম্বারের কেন্দ্রে গিয়ে ব্যালট চুরীর অভিযোগ আনেন। এতে ওসি সাব নির্বাচন কমিশনের অনুমতিক্রমে উক্ত কেন্দ্রের  ভোট স্থগিত ঘোষণা করেন। 

বাদবাকী কেন্দ্রের ফলাফলে দেখা যায় বাচ্চু মিয়া সামান্য এগিয়ে রয়েছেন তবে তৈয়ব মেম্বারের কেন্দ্রের ফলাফল পেলে তবেই কে হবেন আগামী দিনের চেয়ারম্যান তা নির্ধারিত হবে। আগামী মাসের ২০ তারিখে তৈয়ব মেম্বারের কেন্দ্রের ভোট হবে মর্মে ইসি থেকে জানানো হয়েছে। 

তৈয়ব মেম্বার নিজেই বাচ্চু মিয়ার দলে আছেন কিন্তু তবুও চিন্তা যাচ্ছে না। চেয়ারম্যান হওয়াটা এখন বাচ্চু মিয়ার কাছে প্রেস্টিজের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি তৈয়ব মেম্বার ও ওসিকে নিয়ে মিটিং করেন কিভাবে ঐ সেন্টারে ভোটে জেতা যায়। সাজু শেখ ও ভেলু ব্যাপারী দিনরাত ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চু মিয়া হলে কি কি সুবিধা পাবে তার সাফাই গেয়ে বেড়াচ্ছে। তৈয়ব মেম্বার প্রস্তাব করেন,ঐ ওয়ার্ডের সকল ভোটার মন্ডল সাহেবের কথামত চলেন। মন্ডল সাব যাকে ভোট দিতে বলবেন ভোটাররা তাকেই ভোট দিবেন। তবে মন্ডলসাব কোন টাকা পয়সা দিয়ে কেনার লোক না। তাকে পঞ্চায়েত কিনতে পারবে না। 

-তাহলে উপায় কী? ওসি সাব চিন্তিত হয়ে পরলেন। তিনি টাকা নিলেও বাচ্চু মিয়াকে দিল থেকে ভালবাসেন।

- তৈয়ব মেম্বার লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বললেন, উপায় একটা আছে।

এতোক্ষণে বাচ্চু মিয়ার চোখেমুখে হাসির রেখাপাত লক্ষ করা গেল। তিনি আরাম কেদারা থেকে শিরদাঁড়া সোজা করে বললেন, বলো তৈয়ব কী উপায়। যেকোন মূল্যেই হোক আমাকে চেয়ারম্যান হতেই হবে। 

-মন্ডল সাহেবের একটি বিধবা বোন আছে। তার সাথে যদি বাচ্চু ভাইয়ের কোন রকম আত্নীয় হয়ে যায় তবে মন্ডল সাব তার নিজের সম্মানের কথা ভেবেই বাচ্চু ভাইকে সমর্থন করবেন।

ওসি সাব একথার ঘোর বিরোধিতা করে বলেন, না না তা হয়না। বাল্য বিবাহ যেমন অপরাধ, বয়স্ক বিবাহ তেমন অপরাধ। বাচ্চু ভাইয়ের এই বয়সে বিয়ে করা  ঠিক হবেনা। তাছাড়া ভোটের চিন্তায় মিয়া ভাই কিছুদিন থেকে অসুস্থ। অন্য উপায় খুঁজুন। 

 - ওসিসাব, পুরুষ মানুষের আবার বয়স কিসের? আর বললেন না, বাচ্চু ভাইয়ের শরীর খারাপ হেইডা তো বাসায় তার দেখা শুনা করবার লোক নাই জন্যই। বাসায় একজন গিন্নী থাকলে শরীর এমনিতেই চাঙ্গা থাকে কি বলো সাজু শেখ, পাশ থেকে ভেলু ব্যাপারী এতোক্ষণ পর কথাগুলো বলে সাজু  শেখের সমর্থন চাইলেন। সাজু শেখ তার কথায় সমর্থন করে বললো তা ঠিক। আর বাকী থাকলো বয়স্ক বিবাহ আইন। তারজন্য তো আপনি আছেন। পোষায় দিমুনি। চিন্তা কইরেননা।


ওসি সাব রাজি হওয়ায় বাচ্চু মিয়ার সাথে মন্ডল সাহেবের বিধবা বোনের বিড়ি কারখানার সত্ত্বাধিকারী করে শুভ বিবাহ সম্পন্ন হলো। বিবাহের পর নতুন বৌ আর বরকে পালকীতে করে পঞ্চায়েত গ্রামের উপর দিয়ে নিয়ে আসবার পথে উৎসাহিত জনতা পঞ্চায়েত গ্রামের মানুষকে বিদ্রুপ করতে গিয়ে পালকী নিয়ে নাচ শুরু করে দেয়। এমন সময় বাচ্চু ব্যাপারী পরে গিয়ে কোমড়ে ব্যাথা পাওয়ায় আজ ভোটের দিন তিনি বাসায় একা শুয়ে রয়েছেন। তার নব বিবাহিত স্ত্রী গেছেন কেন্দ্রে ভোট দিতে। বিকেল গড়িয়ে যায় কিন্তু ভেলু ব্যাপারী ও সাজু শেখ বাসায় ফেরেনা।বাচ্চু মিয়ার কলিজা শুকিয়ে আসে। এমন সময় দূর থেকে মিছিলের  আওয়াজ ভেসে আসে, আমার ভাই, তোমার ভাই...।

তারপর আর নামটা শুনা যায়না। একা বিছানায় শুয়ে বাচ্চু মিয়া ছটফট করতে থাকে। পিপাসিত বাচ্চু মিয়াকে এক গ্লাস পানি দিবে এমন কেউ তার পাশে নেই। তার আগের স্ত্রীর কন্যারা তাকে নতুন করে বিয়ে করতে বারণ করেছিল। বাচ্চু মিয়া তাদের কথা শুনেননি। আজ তার পিপাসায় পানি দিবে এমন কেউ তার পাশে নেই। ছটফট করতে করতে বাচ্চু মিয়া বিছানা থেকে মেঝেতে পরে যান, আর অজ্ঞান হওয়ার আগে তার ডাইরীতে লিখেন, যদি কারো ধ্বংস চাও তবে তাকে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দাও..। বাচ্চু মিয়া তার জীবনের শেষ কথাটি বলবার কাউকে না পেয়ে লিখতে বসেন কিন্তু উপর্যুপরি মিছিলের আমার ভাই,তোমার ভাই...  শব্দে বাচ্চু মিয়ার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে তিনি মাটিতে লুটায় পরেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Back To Top