0000

নদী কথন || নদীর নাম: ধরলা || জাহানুর রহমান খোকন



ধরলা ব্রহ্মপুত্র নদের একটি উপনদী। ভূটান, ভারত এবং বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে এই নদীটি প্রবাহিত হওয়ায় ধরলা একটি আন্তর্জাতিক নদী হিসাবে অতি পরিচিত নাম। ধরলা নদীটি হিমালয়ের পূর্ব সিকিমের পাঙ্গোলাখা বিটাং হ্রদ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। উৎপত্তিস্থল সিকিম থেকে প্রবাহিত হয়ে ভূটানের সামত্সে জেলায় প্রবেশ করে। অতঃপর কালিঙ্গপংয়ে আবার ভারতে ফিরে আসে। ধরলা নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভারতে ধরলা নদীকে কোথাও সিঙ্গিমারী আবার কোথাও জলঢাকা নামে ডাকা হয়। তবে বাংলাদেশ অংশে এর নাম ধরলা।


ধরলা নদী ভারত থেকে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী জিরো পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।এই ধরলা নদীটির উৎপত্তিস্থল ভিন্ন এবং পানি প্রবাহ অনেক কম। তুলনামূলক কম প্রবাহমান এই ধরলা নদীর পানির উৎস ভারতের জলপাইগুড়ির গরুমারা জাতীয় উদ্যানের ভিতরের থেকে প্রবাহিত ঝর্ণাধারা। অতঃপর ধরলা নদীটির এই ক্ষীণ প্রবাহিত ধারাটি জোংড়া ইউনিয়নে এসে আবারো ভারতে প্রবেশ করে। বুড়িমারী-চ্যাংড়াবান্ধা এই অংশ দিয়ে প্রবাহিত ধরলা নদীর বালুতে প্রচুর পরিমানে সিলিকন থাকে। বাসাবাড়ি নির্মাণসহ কনস্ট্রাকশন সেক্টরে এই অংশের বালুর প্রচুর চাহিদা। এখানে নদীর স্রোতের টানে নুড়িপাথর ভাটিতে চলে আসে। জোংড়া ইউনিয়ন ও শ্রীরামপুর ইউনিয়নে কয়েকবার এই ক্ষীণ প্রবাহমান ধরলা ভারত বাংলাদেশ করে পূর্বদিকে বাঁক নেয়। ভারতের পানাগুড়ি নামক স্থানে এসে মূল ধরলা নদীর সাথে মিশে যায়। বুড়িমারী থেকে নেমে আসা ধরলা পানাগুড়িতে মিলন হওয়ার আগে এই মূল প্রবাহমান ধরলার নাম জলঢাকা এবং মিলনের পর নাম হয় সিঙ্গিমারী নদী।

বুড়িমারী-চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্তে ধরলা নদীর প্রবেশ। 


সিঙ্গিমারী নদী নামটি ভারতে প্রচলিত হলেও এপার বাংলার মানুষ একে ধরলা নামেই জানে।  ভারত থেকে সিঙ্গিমারী নদীটি এবার বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলা সদরের মোঘলহাট ইউনিয়ন দিয়ে ধরলা নাম ধারণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। উল্লেখ্য যে, ধরলা নদীর এ-ই অংশে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের একটি রেল ট্রানজিট পয়েন্ট ছিল মোঘলহাট। যা ১৯১২ সালে চালু হয়। নদী ভাঙ্গণের ফলে ১৯৯১ সালে রেল বন্ধ হয়ে যায়।  ধরলা নদীর উপর ভারত অংশে এখনো কালের সাক্ষী হয়ে সেই লোহার রেল সেতুটি দাঁড়িয়ে আছে।

মোঘলহাট-দিনহাটা সীমান্ত ধরলা নদীর বাংলায় প্রবেশ

ধরলা নদী এরপর দক্ষিণদিকে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলা দিয়ে ভাটির দিকে প্রবাহিত হয়। এসময় ফুলবাড়ি উপজেলায় দ্বিতীয় ধরলা সেতুর নিচে বারোমাসি নদী নামে অন্য একটি নদী ধরলা নদীতে এসে তার প্রবাহ হারায়। ফুলবাড়ি উপজেলা হয়ে ধরলা নদীটি কুড়িগ্রাম জেলা শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ও বুড়াবুড়ি ইউনিয়নে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীর সাথে মিলিত হয়। সর্বশেষ মোঘলহাট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের পর বুড়াবুড়ি ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র নদে মিলিত হওয়া অবদী ধরলা মোট ৫৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে। ধরলা নদীর গড় গভীরতা ১২ ফিট এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ৩৯ ফিট। নদীটির প্রস্থ কোথাও সাড়ে তিন কিলোমিটার আবার কোথাও আধা কিলোমিটার। তাইতো সৈয়দ শামসুল হক তার সাহিত্যকর্মে এই নদীকে আধকোশা নামে উল্লেখ্য করেছেন। এছাড়াও আব্বাসউদ্দীনের ''ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে..'' ভাওয়াইয়া গানে ধরলা নদীর কথা শুনা যায়।

কুড়িগ্রাম শহরস্থ ধরলা ব্রীজ থেকে তোলা- ছবি: লেখক

নদী ভরাট হতে হতে শুষ্ক মৌসুমে ধরলা নদীতে এখন আর পানি থাকে না। হেঁটে পার হওয়া যায়। বর্ষাকালে তাইতো নদীর দু'কূল জলে থইথই করে। এ সময় ধরলা কয়েক কিলোমিটার আকার ধারণ করে। এসময় ধরলাপাড়ে ব্যাপক ভাঙ্গণ হয়। নদী গবেষকদের মতে উজানে ধরলা নদীতে পানি প্রবাহে বাধা দেওয়ায় ধরলা নদীর স্রোত কমে গেছে। এজন্য প্রতিবছর নদী ভরাট হয়ে মরে যাচ্ছে। নদীটি খনন জরুরী। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ধরলা নদীর পরিচিতি নাম্বার হলো উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ৫৯।

ধরলা-ব্রহ্মপুত্র মিলিত স্থলে ধরলার কাছে(শুষ্ক মৌসুম) বুড়াবুড়ি ইউনিয়নে লেখক

লেখক-

জাহানুর রহমান খোকন

নদী কর্মী

কুড়িগ্রাম। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. উল্লাস মিত্রজুন ২২, ২০২২

    আমার স্বপ্নের নদী ধরলাকে নিয়ে লেখকের এই তথ্যসমৃদ্ধ প্রচেষ্টা সুন্দর হয়েছে। কখনও যদি কুড়িগ্রাম যাই, তবে আপনার সাথে ধরলা নদী দেখতে যাব। ধরলা তীরের সেই নারীটিকে খুঁজব, যে আমার হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন পেতে রয়েছে।

    উত্তরমুছুন

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Back To Top