0000

পরিচয় যখন বুড়াবুড়ি || জাহানুর রহমান খোকন

 

(ছবি ধারণের সময়)প্রবীণ বাছর উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী

মানুষ উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে মিল অমিল নিয়ে রয়েছে নানারকম চমকপ্রদ গল্প ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। বানরের বিবর্তনের ফলে আজকের মানব সমাজ নাকী মানব সমাজের ইতিহাস স্বতন্ত্র!  এই নিয়ে বিতর্ক চলছেই। কিছু কিছু সম্প্রদায়ের বিবর্তনের ইতিহাসও কিন্তু কম মজার নয়। উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ি গ্রাম সেরকম একটি।

কথায় আছে, নাম মানুষকে বড় করে না, মানুষেই নামকে বড় করে। তেমনি একজন সাধারণ মহিলা মানুষ, মতান্তরে একজন মহিলা ও একজন পুরুষ বুড়াবুড়ির কর্মকান্ড তথাকথিত তাদের ডাকনাম(বয়স অনুসারে) বুড়াবুড়ি আজ কালের বিবর্তনে ইতিহাস হয়ে একটি গ্রাম তথা একটি ইউনিয়নে রুপান্তর হয়েছে।

ঘটনাটি ঘটেছে কুড়িগ্রাম জেলায়। জেলার উলিপুর উপজেলার একটি গ্রামের নাম বুড়াবুড়ি। এমনকি  সরকারি দফতরে গ্রামটির ইউনিয়নের নামও বুড়াবুড়ি। উপজেলা সদর থেকে পূর্ব-উত্তর দিকে এই গ্রাম অবস্থিত। এই বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের মোট আয়তন ৯৮৩৩ একর। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এই ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যা ৩৩০৯০ জন,  স্বাক্ষরতার হার ৩৯.৬%, যার মধ্যে নারী শিক্ষার হার ৩৬.৬% এবং পুরুষ ৪৩.৩%।


ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের কোলঘেষে এই গ্রাম অবস্থিত। বুড়াবুড়ি গ্রামের জন্ম ঠিক কত বছর পূর্বে তা কেউ বলতে পারে না,  কিন্তু এই গ্রামের নামকরণের ইতিহাস নিয়ে লোকের মুখে মুখে রয়েছে হরেক রকম গল্প। যা বংশ পরস্পরায় দাদার কাছ থেকে নাতী- নাতনীতে বিবর্তন লাভ করে নতুন রুপ পেয়েছে। 

পল্লী চিকিৎসক ইছা খন্দকার(৭৬) স্মৃতি হাতরে বলেন, এই এলাকায় এক বুড়া আর এক বুড়ি বাস করতেন তাঁরা অনেক সম্পত্তির মালিক ছিলেন কিন্তু তাদের কোন ছেলে মেয়ে ছিল না, তাঁদের বাসায় একটি মুদি দোকান ছিল, এলাকার সবাই এই বুড়াবুড়ির দোকানে বাকীতে খরচ নিত। একদিন সকালে দেখা গেল বুড়াবুড়ি দুজনে মরে পরে আছেন। তাদের মৃত্যুর পর সেই দোকান বন্ধ হয়ে যায়। তার পর এলাকার ঘুগান ব্যাপারী,ফুটকুন ব্যাপারী ও বকিওতুল্লাহ ব্যাপারী মিলে সেই বুড়াবুড়ির দোকানের পাশে তিনটি নতুন দোকান দেন, আস্তে আস্তে সেখানে মানুষ জন আসতে থাকেন। জন্ম হয় বুড়াবুড়ির হাটের। ইছা খন্দকার এই গল্প শুনেছেন তাঁর দাদার কাছ থেকে,তার দাদা আবার তাঁর পর দাদার কাছ থেকে শুনেছিলেন এই গল্প।

বর্তমানে বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের প্রবীণ ব্যক্তি (ঘটনা লেখার সময়) বাছর উদ্দিন, তার বয়স ১০৭ বছর। বাছর উদ্দিন জানান, এই এলাকায় এক সময় বনজঙ্গলে ভরা ছিল। ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের ভাটি অঞ্চল থেকে ডাকাত এসে মাঝে মাঝে ডাকাতি করতো এই গ্রামে, তাই ডাকাতের ভয়ে গ্রামবাসী কেউ আর মাগরিবের পর বাইরে বের হত না। এলাকায় এক বুড়ি বাস করতেন, বুড়ীর ছিল অনেক সম্পত্তি কিন্তু সেই বুড়ি ছিলেন নিঃসন্তান। তার কোন আত্মীয় ছিল না। একই এলাকার প্রভাবশালী বৃদ্ধ আরজউল্লাহ শাহ্‌ ফকির বুড়িকে প্রস্তাব করেন, এলাকার উন্নয়নের জন্য সেই গ্রামে একটি স্কুল করে দেওয়ার জন্য, বুড়ি রাজি হলেন, বুড়ীর টাকায় আরজউল্লাহ শাহ্‌ ফকিরের এক একর জমিতে একটি মাইনর স্কুল চালু করা হয়। স্কুলটি বুড়াবুড়ির স্কুল নামে পরিচিত ছিল। যা বাজারের পূর্ব দিকে ছিল, ১৮৮৯ সালে তা বাজারের পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে নিয়ে আসা হয়। এখন তা বুড়াবুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে পরিচিত।

বুড়াবুড়ি কমিউনিটি ক্লিনিক।

বুড়ীর মৃত্যুর পর সেখানে স্কুলকে কেন্দ্র করে বাজার স্থাপন করা হয় সেই বাজারের নাম ও রাখা হয় বুড়াবুড়ির বাজার। দেশ স্বাধীনতার পর ডাক্তার আক্কাস আলির বাবা দেলছার আলি, ইছা ডাক্তার ও সমশের আলি ব্যাপারী মিলে ১৯৭৬ সালে বাজারের পাশে একটি স্কুল প্রতিষ্টা করেন, তার নাম ও রাখা হয় বুড়াবুড়ি উচ্চ বিদ্যালয়। এভাবে কালের বিবর্তনে ইতিহাস হয়ে রয়েছে বুড়াবুড়ি গ্রাম ও হাজারো মানুষের পরিচয় বুড়াবুড়ি।


লেখক-

জাহানুর রহমান খোকন

কুড়িগ্রাম, বাংলাদেশ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

5 মন্তব্যসমূহ

  1. নতুন কিছু জানলাম 🙂

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  3. বুড়াবুড়ি ইউনিয়ন'র অবস্থান কুড়িগ্রাম সদর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। আমার বাড়ি বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের পাশে মোঘলবাসা ইউনিয়নে।

    উত্তরমুছুন
  4. প্রিয় পাঠক, আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ৷ বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের অবস্থান কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এটা আপনি ঠিক বলেছেন। কিন্তু আমি উলিপুর উপজেলা থেকে এটার দিক বর্ণনা করেছি। উপজেলা থেকে পূর্ব-উত্তর দিক এজন্যই বলেছি।
    ভাল থাকুন

    উত্তরমুছুন

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Back To Top