মুখস্থ বিদ্যা ভয়ংকর কথার সাথে কমবেশী আমরা সবাই পরিচিত। কুড়িগ্রাম জেলার নদ-নদীর ক্ষেত্রে এরকম ভয়ংকরী ঘটনা ঘটেছে। কবে কে বলেছেন কুড়িগ্রাম জেলায় ১৬ টি নদ-নদী আছে আর সেটা বর্তমানেও বেদ বাইবেলের মতো আমরা মুখস্থ করে যাচ্ছি। কেউ মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছে না সত্যি সত্যি ঠিক কতটি নদ-নদী রয়েছে। আপনারা যারা অর্ধশতাধিক নদ-নদীর কুড়িগ্রামকে ১৬ নদীর জেলা জ্ঞানে মুখস্থ করেছি, আপনারা শিয়ালদহ নদীটির নাম জানবেন। কিন্তু নদীটির অবস্থান ঠিক কোথায় সেটা অনেকেই জানেন না। আর আপনারা যারা মুখস্থ বিদ্যায় অভ্যস্ত তারা জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে উঠবার অভিমুখে সিঁড়িতে ফ্রেমে বাধাই করা শিয়ালদহের অবস্থান রৌমারী জানবেন।যেখানে নদীটির দৈর্ঘ্য ২৫ কি.মিটার দেখানো হয়েছে। কিন্তু কোন তথ্যসূত্র থেকে এই শিয়ালদহ নদী রৌমারীর হলো সেটা পানি উন্নয়ন বোর্ড যেমন জানেন না, তেমনি তারা এটাও জানেন না যে শিয়ালদহ নদী ঠিক কোথায় অবস্থিত। এমনকি পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় এই নদীর পরিচিতি নাম্বার সম্পর্কেও তারা অবগত নন।
নদী নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের এরকম উদাসীনতা নদী মাতৃক বাংলাদেশ তথা কুড়িগ্রাম জেলার কৃষি ও জনজীবনে নিকট ভবিষ্যতে কাল হয়ে দাঁড়াবে।
একটি আন্তঃসীমান্ত নদী শিয়ালদহ। শিয়ালদহ নদীটি সর্পিলাকার। তবে ভরাট হতে হতে বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে এই নদীতে তেমন পানি থাকে না। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে নদীর দুই তীর পানিতে ভরাট হয়ে যায়। ফলে শিয়ালদহ নদী তীরবর্তী অংশে বন্যা হয়।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পিলার ১০৩৮ এর পূর্ব-উত্তর দিক দিয়ে শিয়ালদহ নদী ভারত থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। নদীটি নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়ন ও ব্লভেরখাস ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শিয়ালদহ নদীটি মূলত ব্রহ্মপুত্র নদের একটি শাখা নদী। ১৭৮৭ সালের ৫ মিনিটের ভূমিকম্পের আগে ধুবড়ি বন্দরের কাছে ব্রহ্মপুত্রের দুইটি ধারা ছিল। একটি দক্ষিণদিকে প্রবাহিত হতো অন্যটি পশ্চিমদিক দিয়ে প্রবাহিত হতো। দুই পথ দিয়েই বাংলাদেশের সাথে ধুবড়ি বন্দরের নৌ যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ভূমিকম্পের পর ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিমদিকের গতিপথে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। ফলে ধুবড়ি বন্দর থেকে পশ্চিমমুখী ভাবে প্রবাহিত ধারাটি অপেক্ষাকৃত কম শ্রোত নিয়ে ধুবড়ি বন্দর থেকে দীঘলটারীতে এসে দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়। যার একটি অংশ টাকিমারীর পাঠামারী ক্যাম্পের পাশ দিয়ে নেমে বাংলাদেশের তরীর হাট,উত্তর শৈলমারীর দক্ষিণ দিয়ে প্রবাহিত হয়। যার নাম শিয়ালদহ। অন্য অংশটি ১০৩৮ পিলারের দক্ষিণ দিক দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নামেই প্রবাহিত হয়ে গরুভাসার চরের দক্ষিণে গঙ্গাধর নদীতে মিশেছে।
শিয়ালদহ নদীটির বাংলাদেশ অংশে প্রবাহিত ধারাটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৯ কিলোমিটার। ভারতের পাঠামারী ও বাংলাদেশের ভোগডহর এলাকা দিয়ে প্রবেশ অন্তর শিয়ালদহ নদীটি পূর্ব পাখিউড়া-ঝাউকুটি-কালারচর-বংশীরচর-গরুভাসা চর হয়ে গঙ্গাধর নদের সাথে মিলিত হয়েছে।
দেশ বিভক্তির পূর্বে ধুবড়ি বন্দর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ হয়ে পণ্যবাহী জাহাজ শিয়ালদহ নদী দিয়ে গঙ্গাধরে আসতো। শিয়ালদহ নদীর পশ্চিমে গঙ্গাধর নদীর তীরে ব্লভেরখাস ইউনিয়নের মাদারগঞ্জ মাঝিপাড়ার দক্ষিণে জাহাজঘাট এখনো লোকের মুখে মুখে প্রচারিত ঐতিহাসিক স্থান। আবার শিয়ালদহ নদী ও গঙ্গাধরের মিলনস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার ভাটিতে নুনখাওয়া ইউনিয়নের ব্যাপারীর চর এলাকার জাহাজডুবীর ঘটনা সকলের জানা। স্থানীয় প্রবীন ব্যক্তিদের তথ্যমতে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার সময় ধুবড়ি বন্দরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমান একটি পণ্যবাহী জাহাজ নুনখাওয়া ইউনিয়নের ব্যাপারীর চর এলাকার পাশে গঙ্গাধর তথা ব্রহ্মপুত্রের নুনখাওয়া বন্দর এলাকায় নোঙ্গর করে অনুমতির অপেক্ষায় ছিল। এমন সময় দেশভাগের ফলে স্থানীয় লোকজন জাহাজটি লুট করে। মাঝি মাল্লারা জাহাজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মালামাল বিক্রি করে দিয়ে কুঠারের সাহায্যে জাহাজটি ডুবিয়ে দেয়।। যা এখনো ব্যাপারীর চরের কাছে আছে বলে স্থানীয়রা দাবী করেন। কয়েকবছর আগেও জাহাজের সাইলেন্সর পাইপ জেগে উঠলে কেউ কেউ সেই পাইপ কেটে নিয়ে যাওয়ার কথাও স্বীকার করেন।
সময়ের পরিক্রমায় এবং খননের অভাবে ব্রহ্মপুত্র নদ, গঙ্গাধর ও শিয়ালদহ নদের নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে চিলমারী বন্দর থেকে এই নদীপথটি এখন ধুবড়ির সাথে আর যোগাযোগ স্থাপনে কিংবা ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার হচ্ছে না। অথচ নদী খনন করে এই নৌ পথটি চালু করলে নদী বাঁচার পাশাপাশি পণ্য আমদানী রফতানীতে সময় ও খরচ প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে।
লেখক-
জাহানুর রহমান খোকন
নদীকর্মী, কুড়িগ্রাম।
khokonjahanur@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ
মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।