0000

বর্ষার রবীন্দ্রনাথ ।। আশরাফ রাসেল



“আবার এসেছে আষাঢ়
আকাশ ছেয়ে
আসে বৃষ্টির সুবাস, বাতাস বেয়ে....”
রবীন্দ্রনাথ তার জীবনপ্রকৃতিতে বর্ষাকে মেখেছে অতুল প্রেমে। প্রেম, বিরহ, জীবনানন্দ সবটুকুই যেন বর্ষার আশিবার্দ। বষার্ই যেন কবির কবিসত্তার অভাব পূর্ণ করেছে। বর্ষা না থাকলে প্রকৃতি যেমন বঞ্চিত হত এক নিবিড় সৌন্দর্য্য থেকে তেমনি কবির হয়তো কখনো প্রেমে পড়াই হতো না। বর্ষার বিচিত্ররুপ কবি মনে নবপ্রেমের উস্কানী দিয়েছে গভীর সচেতনতায়। বর্ষাকে তাই তো কবি প্রেমের উপযুক্ত ক্ষণ হিসেবে বেছে নিয়েছেন, লিখছেন-
                                   ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘন ঘোর বরিষায়’
কদম ফুলের রুপ ও গন্ধে কবি আত্নহারা হয়েছেন বারবার। চারদিক মাতাল করা কদম ফুলের রুপ কবি মনে নাড়া দিয়েছে প্রতিবার নতুন করে। কদমের ভরা যৌবনা প্রেমে কবি মুগ্ধ হয়েছেন। সে ফুলের ছোঁয়া মেখে কবি যৌবনে প্রেমের উপলব্ধি করতে পেরেছেন। কদম ফুলের ছোঁয়ায় কবি নবপ্রেমকে আলিঙ্গন করেছেন।  প্রকাশ করেছেন - ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল,করেছ দান / আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান'।
রবীন্দ্রনাথ এক সীমাহীন প্রেমের নাম, আদ্যন্ত কবি। তার কবিতা, গানে, গল্পে, উপন্যাসে সে প্রেমকে তিনি দেখিয়েছেন শিল্পের কারুকার্যে। এত নির্মহ প্রেম, এত গভীর ভালবাসার উপস্থাপনা রবীন্দ্রনাথের রচনাতেই সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতায় অমিত ভালবেসে লাবণ্যর নাম দিয়েছিল ‘বন্যা’। নাম ভুমিকায় বলেছিল, “বন্যা হঠাৎ এল তারই (ব্রক্ষ্মপুত্র) কুল ভাসিয়ে দিতে।” অমিত তার নিজের নাম ব্রক্ষ্মপুত্র রাখতে চায়। মুলত, বন্যার সাথে বর্ষার যে গভীর আত্নীয়তা, বর্ষা এলে চারপাশ ছাপিয়ে বন্যা অবধারিত। সেই বর্ষাকে কি কবি কখনো ভুলে যেতে পারেন? যে বালক কবি বর্ষার সৌন্দর্য্য উপেক্ষা করতে না পেরে লিখেছিলেন- ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে / তোমার কথা মনে পড়ে’ ?
গ্রীষ্মের তাপদাহের সমাপ্তি ঘটিয়ে বর্ষা যখন আসে প্রকৃতিকে সজিবতার পরশে স্নেহ বোলাতে, কবিমন সে পরশ উপেক্ষা করার স্বাধ্য রাখে না। বরং সে পরশ কবির হৃদয়কে জাগিয়ে তোলে, পাগল করে, করে ছন্নছাড়া- দিশেহারা। দিশেহারা হয়ে কবি গান-

“পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে”
সত্যিই কবি যেন পাগল হলেন। বর্ষার ছলছল জলধারা, ঝরঝর বর্ষণ কবি হৃদয়কে মুখরিত করে তুললো। কবি হলেন বাঁধনহারা, হলেন বেপরোয়া। নতুন প্রেমের আগমন প্রেমিক মনকে যেমন উদাসীন করে তেমন শিকল ছেঁড়া। কবি ব্যক্ত করলেন-

‘জানিনে জানি নে
কিছুতে কেন যে মন লাগে না’
কবি জানবেনই বা কী করে। বর্ষার বিচিত্র রুপে যে কবি উন্মত্ত তার আর এসব জানবারই বা কী আছে। কবি নিজের অগোচরে যাকে হৃদয় সপে আছে, সে তো লাবণ্যময়ী বর্ষা। যে শ্রাবণের ডাকে কবি তার হৃদয় দুয়ার খুলে বসে আছেন, তার নতুন করে জানার আর কী বাকি থাকে! মেঘের সাড়া পেয়ে কবি যেন ময়ূরের মত চকিত হয়েছেন। বৃষ্টির রিমঝিম নৃত্যে কবি গেয়েছেন- ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচেরে’। সে আনন্দ, প্রেম, উন্মত্ততা যেন কবিকে মেঘের দোসর করেছে। মেঘের ভেলায় উড়েছেন অজানায়। লিখেছেন-
‘মন মোর মেঘের সঙ্গী / উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে’

বর্ষার প্রতিটি রুপ কবির হৃদয় কেড়েছে। বর্ষা কন্যার অতি লোভনীয় সে রুপ যেন ফুটেছে  নিশিথ রাত্রে। চারপাশ ঘোর অন্ধকার। বৃষ্টির ঝরঝর,   ঝরঝরে বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছে তরুলতা, বিদ্যুৎ-মেঘে লুকোচুরি খেলা, সচকিত গর্জনে বাতাসের শনশন শব্দে কবি গভীর রাত্রির ঘুমকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হলেন। উপভোগ করলেন সে সৌন্দর্য্য।  কবি লিখলেন-

‘আমি তখনও ছিলেম মগন
গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল
তিমির নিবিড় রাতে যখন বৃষ্টি নামল’
সে গভীর রাত্রে কবি যেন গভীর প্রেমের আশ্বাস পেয়েছেন। যে প্রেমের জন্য কবি আকুল হয়ে বসে আছেন সেই প্রেমই বুঝি এ বৃষ্টিস্নাত রাতে ধরা দিয়েছে কবির হৃদয় ডোরে। কবি প্রকাশ করলেন- ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার/ পরাণ সখা বন্ধু হে আমার’।
যে প্রেমে কবি আত্নহারা সে প্রেমের প্রাপ্তহীনতা কবিকে বিরহ জলে ডুবিয়েছে সমভাবে। নীল মেঘের ভেলা করে সে বেদনা কবিকে দংশন করেছে, বর্ষা জলে করেছে প্লাবিত। বেদনাঘন আবেগে কবি তাই প্রকাশ করেছেন-

‘যেতে দাও যেতে দাও গেল যারা
তুমি যেও না তুমি যেও না
আমার বাদলের গান হয়নি সাড়া’
রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে সম্পূর্ণরুপে উপভোগ করেছেন তার জমিদারীর দিনগুলোতে। রচনা করেছেন ‘বর্ষামঙ্গল’ কাব্যের মত রচনা।  বর্ষাকে কবি যেমন প্রেমিক রুপে কল্পনা করেছেন তেমনি জীবনের রুপরেখায় কবি দেখিয়েছেন বর্ষার উপঢৌকন। আবার এই বর্ষাই কবিকে দ্বিধান্বিত করেছে। আষাঢ় শ্রাবণের বহুরুপী আকাশের উপর কবি তাই আস্থা রাখতে পারেন নি। সে শঙ্কায় কবি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে লিখেছেন-
‘গগনে গরজে মেঘ এল বরষা
কুলে একা বসে আছি নাহি ভরসা’
সে কারণে কবি বারবার সাবধান করেছেন, সতর্ক করেছেন। বর্ষা দিনের কর্মপরিসরকে ব্যাখ্যা করেছেন। বর্ষাকে নিভৃতে উপভোগ করার জন্য কবি আহ্বান জানিয়েছেন-
 ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে
 তিল ঠাঁই আর নাই রে
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’
এমনও হতে পারে এ কারণেই কবি কর্মচঞ্চলতা থেকে সরিয়ে নিজেকে সময় দেবার পথ খুঁজেছেন। খুঁজেছেন অবসর। নিজের মত করে বাঁচার। নিজের মত করে ভালবাসার। বর্ষার রুপ-লাবণ্যতার কাছে বশ্যতা স্বীকার করে, বর্ষার সাথেই সখ্যতা গড়তে চেয়েছেন বুঝি। তাই তো কবি আর্জি করেছেন-
‘দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর
ভালবাসিবারে দে আমারে অবসর’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. আপনার লেখা এই কবিতাটি আমি পড়েছি এবং এটি আমার খুব ভালো লেগেছে। আপনি চাইলে নতুন প্রেমের কবিতা পড়তে আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করতে পারেন।

    উত্তরমুছুন

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Back To Top