0000

হাতিয়া গণহত্যা || উত্তরবঙ্গের সবথেকে বড় গণহত্যার ইতিহাস

 


হাতিয়া  বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার একটি ইউনিয়ন। মাত্র ৩০.৬৪ বর্গকিমি এলাকা নিয়ে বিস্তৃত এই জনপদে রংপুর বিভাগের সবথেকে বড় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে তৎকালিন বৃহত্তর রংপুর জেলায় যতোগুলো গণহত্যা সংঘঠিত হয়েছিল, হাতিয়া গণহত্যা তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় গণহত্যা। যা কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নে সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী  নিরীহ ৬৯৭ জন মানুষকে হত্যা করবার পাশাপাশি গাবুরজান, বাগুয়া অনন্তপুর, রামখানা, নয়াদাড়া, নীলকণ্ঠ, কলাতিপাড়া, শ্যামপুর,কামারটারী ও দাগারকুটি গ্রামের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে গৃহপালিত পশু ও ঘরে আটক থাকা নিরীহ মানুষ পুড়ে মারা যায়। ঘরে ঘুমন্ত ও আটকা পড়ে যারা মারা যায়, তাদের মধ্যে বেশিই ভাগই ছিল নারী ও শিশু। যারা আগুন থেকে পালিয়ে ছিল তাদের ধরে কাউকে কাউকে হাত-পা বেঁধে আগুনে ফেলা দেয়া হয়েছিল আবার অনেককে সারিবদ্ধ করে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়।  মৃত্যু নিশ্চিত করতে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে লাশগুলোকে ব্রহ্মপুত্র নদে ফেলে দিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। 

২০০৯ সালে নির্মিত শহীদ স্মৃতি



হাতিয়া আক্রমণের অঘোষিত কারণ:

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রৌমারী মুক্তাঞ্চল ছিল। কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনঠাসা করা সম্ভব হলেও কুড়িগ্রাম জেলায় মুক্তযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ঘাটিসহ মুক্তাঞ্চল হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীদের উপর চাপ আসে কুড়িগ্রামকে লণ্ডভণ্ড করে দেওয়ার। বিশেষত ১১ অক্টোবর ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর আবু তাহের এর নেতৃত্বে চিলমারী রেইড এ হেরে গিয়ে পাকিস্তানিদের মাথায় যেন বারুদ জ্বলে উঠে। তারা চারিদিকে পাকিস্তানি খোচরদের কাজে লাগিয়ে দেয়, কোথায় কোথায় মুক্তি বাহিনী লুকিয়ে আছে তার খোঁজ নিতে। খোচরদের গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তানি বাহিনী হাতিয়া ও তার পাশ্ববর্তী স্থানে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের অবস্থান বুঝতে পেয়ে হাতিয়া ছেড়ে ঘুঘুমারীর চরে চলে যান। ১১ নভেম্বর আবুল কাশেম চাঁদ তার কোম্পানির দায়িত্ব প্লাটুন কমান্ডার শওকত আলী সরকারের উপর সাময়িকভাবে হস্তান্তর করে কোচবিহার গমন করেন। এ সময় মুক্তিবাহিনীর বাদলের এক প্লাটুন ফোর্স বুড়াবুড়ির দাগারকোটে অবস্থান করতেছিল। 

দাগারকুটি বধ্যভূমিতে লেখক



 নিরস্ত্র মানুষের উপর বর্বরোচিত আক্রমণ:

১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর(২৩ শে রমজান) শনিবার।  গ্রামের বেশির ভাগ ধর্মপ্রাণ মানুষ সেহরি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন, আবার কেউ কেউ ফজরের নামাজের জন্য ওজু করে নামাজের আজানের অপেক্ষা করছেন। আবার কেউ কেউ মসজিদের পৌঁচ্ছে গেছেন। দূরের কোন কোন মসজিদ থেকে তখন ভেসে আসছে আজানের সুর। এমন সময় তিন দিক থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের সহায়তায় পাকিস্তানী প্রশিক্ষিত মেলেটারী বাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে হাতিয়ার গ্রামগুলো ঘিরে ফেলে। তারপর পাকিস্তানী দোসরদের সহায়তায় যে সকল বাড়িতে মুক্তি বাহিনী আশ্রয় নিয়ে অবস্থান করতো সেই সকল বাড়িতে মুক্তি খুঁজতে থাকে। সেই সাথে চালাতে থাকে বর্বরোচিত তান্ডব। কোথাও মুক্তি বাহিনীর দেখা না পেয়ে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং মুক্তিবাহিনীকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পাকিস্তানি বাহিনীর মর্টার সেল আর বন্দুকের অবিরাম গুলিবর্ষণে প্রকম্পিত হয়ে উঠে হাতিয়ার দাগারকুটি গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলো। এসময় তারা অনন্তপুর বাজারে এসে আগুন লাগিয়ে দেয়। অতঃপর গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে দিতে তারা দাগারকোটের দিকে রওনা হন। এমতাবস্থায় দাগারকোটে যে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করতেছিল তারা ভারী অস্ত্রের নিকট সম্মুখ যুদ্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করে পাল্টা  গোলাগুলি করতে করতে নিকটবর্তী চরে পালিয়ে যেতে থাকেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা হিতেন্দ্রনাথ গর্তে লুকিয়ে থেকে  তার কাছে থাকা পয়েন্ট থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে দেড় শ’রাউন্ড গুলি চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায়। এ সময় পাকিস্তানিদের গুলির আঘাতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা গুলজার হোসেন, নোয়াব আলী, আবুল কাশেম কাচু, দেলোয়ার, আবু বকর সিদ্দিক শহীদ হন। হিতেন্দ্রনাথের রাইফেলের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী তাকে ঘিরে ধরেন এবং  বেয়োনেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে হত্যা করেন।  এই আক্রমণে ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি কমান্ডার শওকত আলী সরকার পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন এবং তিনি তার মুক্তিবাহিনীকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর রক্তে তখনো প্রতিশোধের বারুদ। তারা এবার ঝাপিয়ে পরে গ্রামের নিরহ নর নারীর উপর। ভোররাত থেকে প্রায় ১০ ঘন্টা চলে পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।  প্রাণ বাঁচাতে নিরহ গ্রামবাসী তখন দিকবিদিকশুন্য হয়ে ছুটতে থাকেন। কেউ পাটক্ষেত দিয়ে, কেউ ব্রহ্মপুত্র নদে ঝাপ দেন, প্রাণে বাঁচবার আশায়। আর পাকিস্তানি দোসররা সেই সুযোগে চালায় লুটতরাজ। নারকীয় এই হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে বাবর আলী তার পরিবার নিয়ে পালাতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পরে সারিবদ্ধ অনেকের সাথে তাকেও গুলি করা হয়। তিনি বাম হাত ও বুকে গুলিবিদ্ধ হন। রাত ১১টায় গ্রামবাসী তাকে বাম হাত ও বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠান। তিনি সুস্থ হয়ে ফিরলেও তার ভাই আব্দুল ওহাব ও জোবেদ আলী না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তাদের মা শোক-দুঃখে মাসসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেড় বছর পর মারা যান। 

১৯৭১ সালের হাতিয়া গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী কামাল হোসেন। পাকিস্তানি দোসররা বাড়ি থেকে  কামাল হোসেনকে ডেকে নিয়ে যান। তার সামনে তার বাবা বাবর উদ্দিন, চাচা বক্তার আলী ও দাদা শাহাদুল হককে গলা, হাত ও বুকে গুলি করা হয়। কামাল হোসেন প্রাণে বেঁচে গেলেও বাঁচেনি তার স্বজনেরা। ১৯৭১ সালের সেই দিনের স্মৃতি মনে পরলে কামাল হোসেনের চোখ এখনো ছলছল করে উঠে। টানা দশঘণ্টা ব্যাপী নজিরবিহীন গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালিয়ে ৬৯৭ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি নরখাদক ও তাদের এদেশীয় দোসররা।

 মুক্তিবাহিনীকে না পেয়ে নিরহ মানুষের উপর বর্বরোচিত অত্যাচার করে যখন নরখাদকের দল এলাকা ত্যাগ করে রেখে যায় তখন হাতিয়ার পাড়ার পাড়ায় পরে থাকে লাশের স্তুপ। চারদিকে পোড়া লাশের গন্ধে ভারি হয় বাতাস। পাকিস্তানি মেলেটারী বাহিনী চলে গেলে এলাকাবাসী সকলে মিলে বড় গর্ত করে শহীদের গণকবর দেন।


স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও রাষ্ট্রীয় ভাবে হাতিয়া গণহত্যা দিবস পালন এবং রাষ্ট্রিয় সৃকৃতি পায়নি। কিংবা হাতিয়া গণহত্যায় নিহত শহীদ পরিবারের অনেক পরিবার পায়নি রাষ্ট্রিয় কোন সুযোগ সুবিধা। অথচ ১৯৭১ সালে বৃহত্তর রংপুর জেলার মধ্যে যে কয়েকটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল তাদের মধ্যে সবথেকে বড় হত্যাকাণ্ড এই হাতিয়া গণহত্যা। স্থানীয়ভাবে দিবসটি নানা কর্মকাণ্ডে পালন করা হলেও হাতিয়ায় ২০০৯ সালে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের পাশে নেই শহীদদের নামফলক খচিত তালিকা। নিহতদের যেখানে গণকবর দেওয়া হয়েছিল সে জায়গাটি আজ  ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গণে বিলীন হয়েছে। হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের পাশে শহীদদের জন্য নির্মিত বেদী বছরের পর বছর অবহেলা ও আযত্নে পরে থাকে। ফলে উত্তরবঙ্গের সবথেকে বড় গণহত্যা সম্পর্কে ইতিহাস দিনের পর দিন তরুণদের অজানাই থেকে যাচ্ছে। হয়তো এভাবেই কোন একদিন হাতিয়া গণহত্যার কথা সকলের মন থেকে মুছে যাবে কিন্তু ১৯৭১ সালে শহীদ হওয়া সেই মুক্তিযোদ্ধা ও গণহত্যায় শহীদদের ইতিহাস কী জবাব দিবো?


লেখক-

জাহানুর রহমান খোকন

কুড়িগ্রাম, বাংলাদেশ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Back To Top