0000

ভোটের বাজার || আব্দুল খালেক ফারুক || গল্প

 


ফাঁকা রাস্তা। শীতকালের সকাল। তাই লোক চলাচল কম। মোহাম্মদ আলেফ উদ্দিন কাকডাকা ভোরে আজ বাড়ি থেকে বেড়িয়েছেন। পাকা নিয়ত করেছেন, আজ ভোট বিক্রি করবেন। তবে যার তার কাছে তো মহামূল্যবান ভোটটা বিকিয়ে দেয়া যায় না। সেজন্য সলিড লোক দরকার। মালপানি নিয়ে যিনি মালকোচা মেরে ভোটের ময়দানে ডিগবাজি দিচ্ছেন, এমন বেরাদারে ইসলামকে বগলদাবা করতে পারলে জেয়াদা ফায়দা হবে। তাই আজ একে একে ভোটের মার্কেটিং করবেন। যিনি নীলামে জয়লাভ করবেন ভোটটা তার। 


নছর উদ্দিন মার্কেট থেকে কেনা জ্যাকেট গায়ে। মাথায় মাঙ্কি টুপি। এই কয়দিন টানা বিড়ি টেনে একখানা মাঝারি মানের কাশিও বাগিয়েছেন মাশাল্লাহ। খুক খুক কাশি অনেকটা নিয়ম মেনেই ধ্বনিত হচ্ছে। আর হবেই না কেন? বিড়ির দাম বাড়ার পর একটু কমিয়ে দিয়েছিলেন ধূমপান। কিন্তু ভোটের বাজারে মুড়ি সঙ্গে বিড়ি উড়ছে সমানে। এ সঙ্গে ৫০০ বিড়ি গছিয়ে দিচ্ছেন ক্যানভাসাররা। দুই একজন সিগারেটও সাধিয়ে যাচ্ছেন। আহ্ ভোট! তোমার একি মাহাত্ম্য! 


এই আয়েশি ভাবনার সঙ্গে একটা জলিল বিড়ি অনায়াসে ঠোঁটে চলে আসে মোহাম্মদ আলেফ উদ্দিনের। দক্ষিণী সিনেমার নায়ক রজনীকান্তের স্টাইলে বিড়ির অগ্রভাগে অগ্নিসংযোগ করে হাত মুঠো করে টান দিতে শুরু করেন। এই স্টাইলে যিনি সিগারেট টানেন— এমন একজন প্রার্থীকে দিয়ে আজকের বউনিটা করতে চান। এই ক্যান্ডিডেট ভকারু টাইপের। রাজা-উজির মারতে ওস্তাদ। চোখের পাতা পড়ে ঘন ঘন। সঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে জায়েজ করেন যত গালগল্প! লোকে নাম দিয়েছে "চোখ ত্যারপা।" অনেক দিন ধরে চেয়ারম্যান আছেন। মাঝে একবার এমপিও হয়েছিলেন। ১২ দিনের জন্য। আবার চেয়ারম্যান। আহা! কী মধু! মাবুদ জানেন।

 

ধরলার পার ধরে ধরে বাঁধের রাস্তা। সেই রাস্তায় অটো রিকশা পেয়ে চেপে বসে আলেফ। তারপর কাশতে কাশতে হাজির সাবেক এমপি ও বর্তমান চেয়ারম্যান মহাব্বত আলীর ডেরায়। 

—ভাই সালামালাইকুম। 

—কীরে আলেফ! পইল সকালে হাজির হলু ক্যানবা?

—ভাই যে কী কন। আরে সকাল সকাল না আসলে তোমার দেখা পাওয়া যায়? ভোটের বাজারোত সওদা আগোত।

আলেফের কথা বলার ধরণ দেখে সমবেত সবাই হো হো হো করে হেসে ওঠে। 

—তা আসলু যখন এলাকার খবর দে। তোমার ওই দিকে আমার অবস্থা কী? 

—ভাই খালি হামার ওঠায় কন ক্যা? সউগ জাগাতে তোমরা সলিড। খালি সিল মারা বাকী। এবার আগেরবারের চাইয়ে ডবল ভোটে তোমরা যদি না জেতেন, মোর নামে একটা ভুটুয়া কুকুর কোরবানি দেন। 

এবারেও সবাই হেসে ওঠে। হাসির চোটে চায়ের কাপে কাঁপন ওঠে। সবাই স্থানচ্যুত হয়ে পড়ে। এই সুযোগে দু একজন বায়ুত্যাগ করে পেট খালাস করে পেটের গ্যাসের চাপটা কমিয়ে নেন। 

—ভাই একটা গুপ্ত কথা ছিল। একটু সাইডে আসেন। 


বাড়ির অন্দরে নিয়ে গিয়ে গুপ্ত কথার জারিজুরি শুনতে চান চেয়ারম্যান মহাব্বত আলী। 

—ক, তাড়াতাড়ি তোর গুপ্ত কথা ক। দেখিসনা, কত লোক বসি আছে?

—না কথা একটাই। নিয়াত পাকা। ভোটটা আইজ বেচি দেইম। 

—কী ভ্যাজালি কথা কইস। ভোট ফির ব্যাচায় নাকি কাইয়ো?

—ক্যা। জানেন না তোমরা? কবার চান তোমরা ভোট কেনেন না? না কেনেন নাই। হামার ফ্যালে দেওয়া মাল নোয়ায়। যাং—অন্য কোন জাগায় যাং।

—আরে রাগ করিস ক্যা। তুই আমার পুরানা কর্মী। সউগ সময় মোকে ভোট দিছিস—এবারেও দিবু—মুই জানোং। নে, নে, চা-পান খাইস। আর মোর জন্য সবাকে কইস। এবার তোর বছরি কার্ড করি দেইম। ভ্যাজাল শ্যাষ।

চেয়ারম্যান পাত্রী দেখা স্টাইলে মুঠোর মধ্যে টাকা গছিয়ে দিয়ে দ্রুত মজলিসে চলে যান। আলেফ হাতের মুঠো খুলে দেখেন নতুন পাঁচশ টাকা কচকচে নোট। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম পেয়ে খুশি না হলেও দ্রুত পকেটে চালান করে সালাম দিয়ে বেড়িয়ে পড়েন পথে। 


না। ভোটটা বেচাতে পারলেন না। এতো কম দামে এবার ভোট বিক্রি হবেনা। এক বুড়া জন্ডিস এবার জীবনের শেষ ভোটে দাঁড়িয়েছেন, তার বাড়িতে হানা দিতে হবে। জীবনের "শ্যাষ চিকিৎসা" অনেক সময় ফলদায়ক হয়। 

আলেফ আর বিলম্ব না করে কিলো দুয়েক পথ হাঁটতে হাঁটতে চলে আসলেন সেই বুড়ো হাবড়ার বাড়িতে। না, লোক সমাগম তেমন নেই। একেবারে মরার বাড়ি। চল্লিশার পরের দিনের অবস্থা। মনে হয় না ইনি ভোটে দাঁড়িয়েছেন! ভেতরে তসরিফ নিবেন কীনা ভাবতেই বুড়ো একেবারে নাক বরাবর দর্শন দিলেন।

—কীরে আলেফ, এতো সকালে?

—এতো সকালে মানে? এলাতো সকাল আটটা বাজে। 

—আরে, ওই একে কতা। তা কী মনে করি?

—মানে? কী কন? তোমরা ক্যান্ডিডেট মানুষ। তোমার বাড়ি আসলোং। চা-পানি খোয়ান। 

—ইয়ে, চা পানি মারাইছে। থাকিস বাতানের মইষ জবো করি। তোক আইসপ্যার কাই কইছে? মুই ভোটোত দাঁড়াইছোং, ঠেকা মোর। তোর বাড়ি মুই যাইম। 

—একশ ভাগ হালাল কতা কইচেন। এলা বুঝনুং, বারে বারে তোমরা ক্যা ফেল মারেন! শুকান মুখোত মাছি পড়েনা, বাহে।

চেয়ারম্যান কিছু একটা বলবেন—এমন সময় এক রিকশাওয়ালা বেমক্কা আওয়াজ ছাড়ে। 

- চাজি! তিনদিন থাকি মাইকিংয়ের রিকশা ভাড়া পাং না। আইজ না দিলে যাবার নং। তোমরা অন্য রিকশা দেখো। 

ক্যান্ডিডেটের হতশ্রী অবস্থা দেখে আলেফ উদ্দিন অনেকটা অক্কা পাওয়ার দশায় উপনীত হলেন। দ্রুত সটকে পড়লেন বুড়ো হাবড়ার সামনে থেকে। পথে নামলেন আবার। পেটের ক্ষুধাও বাড়ন্ত। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে এক জমজমাট মোড়ে। সেখানে ভাঁপা পিঠার দোকানে ধোঁয়ার ফাঁকে ফাঁকে বাতাসে উড়ছে ভাঁপার সুঘ্রাণ। ঘ্রাণটা পেটের ক্ষুধাটা আরো বাড়িয়ে দিলো। এই দোকানে বসে ক্ষাণিকটা জিরিয়ে নেয়ার মনস্থির করলেন। তিনখানা ভাঁপা পিঠার অর্ডার দিয়ে পকেটে গরম টাকার অস্তিত্ব আর একবার পরখ করলেন। ভাঁপার ভাঁপ নিয়ে আবার পথে।


আলেফ উদ্দিন এবার যাবেন এক ভোট পাগলের দরবারে। এ পর্যন্ত আটবার ভোটে দাঁড়িয়ে ফেল মেরেছেন। নবম দফায় দান মারার তালে আছেন। ভোটের চোটে জমি-জিরাত সব খুইয়েছেন। তবু ক্ষান্ত দিতে রাজী নন। ভোট আসলে কোন পীর যেন স্বপ্নে তাকে দর্শন দেন। কড়া হুকুম করেন: ব্যাটা দাঁড়িয়ে পরো!

ব্যাস! এরকম দৈব্যবাণীকে অগ্রাহ্য করার মতো নাদান মানুষ নন রইচ উদ্দিন ওরফে ভোট পাগলা রইচ। খাজা বাবার আসল ভক্ত। এবার শেষ সম্বল এক একর জমি বিক্রি করে বাজির দান ছেড়েছেন রইচ পাগলা। বিবিসি মোকলেছের কাছে এই পাকা খবরটা তার পেটে স্টক করা আছে। এখনও রিলে করেন নাই। ভাবছেন, নিজে কিছু দাঁও মারতে পারলে তখন রিলে করে কিছু ধান্ধা করা যাবে।

রইচ পাগলার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল এলাহী কান্ড। রইচ পাগলার মাথার একদিকে ঠান্ডা, অন্যদিকে গরম পানি ঢালছেন তার দুই সমর্থক। ঘটনা গুরুতর। তার মনোনয়ন নাকি বাতিল হয়েছে। এ খবর শুনে মাথা বিগড়ে গেছে এই হেভিওয়েট ক্যান্ডিডেটের। মাথা নাকি কিঞ্চিত গরম হয়েছে! তাপ এবং ভাঁপ উঠছে। লক্ষণ সুবিধের না। তাই সমর্থকরা তার মাথা ঠান্ডা করাই এই মুহূর্তের প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য বলে বিবেচনা করছেন। 


মোহাম্মদ আলেফ উদ্দিন এসব কান্ড দেখে নিজেই নিজেকে শাপান্ত করছেন। আজ কার মুখ দেখে যে বের হয়েছেন! ভোট বিকাবেন কী? কোনো জায়গায় ফিট হতে পারছেন না। 


শেষ পর্যন্ত আলেফ উদ্দিন চলে গেলেন ধরলার পারে। চেয়ারম্যান প্রার্থী বাদ দিয়ে মেম্বার প্রার্থীর কাছে গিয়ে অবস্থাটা পরখ করতে চান। প্রথমে গেলেন আসলাম সর্দারের কাছে। মার্কা তরবারি। হ্যাঁ, সর্দারের নামের মর্যাদা অক্ষুন্ন রয়েছে বটে! আসলাম সর্দার পকেটমারের সর্দার ছিলেন। এখনও হাত সাফাই করেন কীনা মাবুদ জানে! যাত্রাপুর আর বড়বাড়ি গরুর হাটে তার দেখা মেলে হামেশা। 


সর্দারের বাড়ি যেতেই খিচুড়ির সুঘ্রাণ নাকে ধাক্কা দিয়ে সরাসরি পেটে চালান হলো। সসপেন ভর্তি খিচুড়ির প্যাকেট নিয়ে সমর্থকরা ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। তার প্রতিদ্বন্দ্বিরা নাকি এক দফা খিচুড়ি বিতরণ করেছেন। তাই সর্দারের পাকা নিয়ত—ভোট পর্যন্ত পাঁচ দফা খিচুড়ি বিতরণ করবেন। আর ভোট কেন্দ্রের পাশে প্যান্ডেল খাটিয়ে সকালে ও দুপুরে শাহী খানার বন্দোবস্ত করবেন। যাত্রাপুর ও বড়বাড়ি হাট থেকে ইতোমধ্যে মহিষ সাইজের দুটি গরু ক্রয় করে আঙিনায় বেঁধে রাখা হয়েছে নমুনা হিসেবে।

হতের লক্ষী পায়ে ঠেলতে নেই। তাই দুপুরে ভরপেট খিচুড়ি খেয়ে পথ খরচার হাজার খানেক টাকা নিয়ে তবেই বের হলেন আসলাম সর্দারের বাড়ি থেকে। সর্দারের বাড়িতে খুব স্বস্তিতে ছিলেন আলেফ তা বলা যায় না। কথার ফাঁকে ফাঁকে বার বার আসলামের চোখ যাচ্ছিল তার পকেট বরাবর। নতুন কচকচে নোটের অস্তিত্ব আর একবার অনুভব করে দারুণ বিপত্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন সেসময়। 

আলেফ এবার ধরলা নদী পার হবার মনস্থির করলেন। ওপারে এক বিখ্যাত সুদখোর নাকি প্রার্থী হয়েছেন। সেখানে ভোট বিকানোর রফা হয় কীনা—এই লক্ষ্য নিয়ে নৌযাত্রার পর তসরিফ আনলেন চরে। 


সুদারু হজরত আলী তখন নাকি চরের বাড়ির অন্দরে অন্দরে। মোড়ের দোকানে দোকানে সুদারু হজরতের জয়ধ্বনি শুনে তিনি আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করলেন। হজরত আলী সমর্থক পরিবেষ্টিত অবস্থায় ধরা দিলেন শেষ বিকালে। 

—ভাইজান—কী ব্যাপার। এ্যাটে বসি ক্যা?

—আরে তোমারে দেখা কইরব্যার আসিতো দিন কাবার। —কন কী? আহারে খবর দিলেতো মুই তোমার বাড়ি গেলুং হয়। নেও বিড়ি ধরান। আগোত গরম হন। জারুয়া দিন। ভোটোত দাঁড়েয়া মোর আক্কেল হইছে। 

আলাপের লাইন সুবিধের নয়। মিশন ফেল হয় কীনা মাবুদ জানেন। আলেফ উদ্দিন একবার দোয়া ইউনুছ পড়ে সবার অজান্তে বুকে ফুঁ দিলেন। ‘আল্লাহ বালা মুসিবত থাকি রক্ষা করেন।’ আলেফ উদ্দিন উশখুশ করছেন দেখে হজরত আলী তাকে সাইডে নিলেন। ভোটের বাজারে গোপন আলাপের এই তরিকা। 
—কন ভাইজান কী কইবেন। 

—আরে তুইতো জানিস এনজিও থাকি একটা গরু দিছিলো, কাইল সেটাই কাঁপনি ধরি মরি গেইছে। এলা তোর ভাবী বায়না ধরছে দুইটা বকরি ছাগল কিনিয়া পুষপে। মাথাটা মোর খারাপ কল্লে। 

—তা বকরি দু্ইটার দাম কত?

—হাইলোন কিনলেওতো তিন তিন ছয় হাজার টাকার নিচোত হয়না। 

অ্যামাউন্ট বলে কম হলো কীনা চিন্তা করছে আলেফ।  

—আচ্ছা, মুই পাঁচ হাজার টাকা দিনুং। বাকীটা তোমরা ভরে সরে কেনো। আর ভাবিক কন, পাড়ার মহিলা মানুষের ভোটগুলো য্যান তায় গোটে দেয়। 

—আরে চিন্তা করেন না। মোর উপরা ছাড়ি দেও। দেখো কী করোং। 

পকেটে পাঁচ হাজার টাকার পাঁচটা নোট মনে হয় ব্যাঙের মত লাফাচ্ছে। অনুভূত হবার পর থেকে মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যাচ্ছে না আলেফ উদ্দিনের। চেষ্টা করেও হাসি মুখটা গম্ভীর করতে পারছেন না। কী জ্বালা! শেষ পর্যন্ত আলেফ উদ্দিনও পাগল হয়ে গেলেন কীনা-সন্দেহ চাগান দিলো। ভোটের বাজারে বেচাকেনা ভালো হলে এমন বাতিক ভর করা বিচিত্র নয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Back To Top