প্রথম যেদিন বাবা-মা সহ ঢাকায় এলাম, পুরো শহরটা অচেনা ছিল।কত মানুষ, কত রাস্তা, কত অলিগলি কিন্তু কিছুই পরিচিত নয়।বাবা-মা, আর আমি তিন জনের সংসার। একটা নতুন জায়গায় সব কিছু গুছিয়ে নিতে একটু সময়ও লাগে।
এখনাকার স্থানীয় একটা কলেজে ইন্টারে ভর্তি হলাম।প্রথমদিন বাবা-ই কলেজে দিয়ে আসল।তারপর থেকে একাই যাত্রা।কয়েকদিন খুব স্বাভাবিক ভাবেই যাওয়া আসা করলাম কিন্তু সঙ্গী করে কাউকে নিতে পারলাম নাহ।একদিন খেয়াল করলাম,কেউ একজন আমার পিছন পিছন আসছিল। তবে সেভাবে গুরুত্ব দিলাম না।এরপর একদিন নয়, দুইদিন নয় প্রতিদিনই সেই মানুষটাকে দেখতে পেলাম।বাসা থেকে বের হাওয়ার পর থেকে কলেজ পর্যন্ত ফলো করে। কিন্তু কিছু বলে নাহ।আমার বিরক্ত লাগে আবার ভয়ও লাগে।
একদিন আমিই তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,
-কেন তিনি আমার পিছন পিছন আসেন।?।
কোন উত্তর দিতে পারে নাহ।আমতা আমতা করেন।আমারও নতুন শহর, তাই তেমন কিছু বলি নাহ।শুধু অনুরোধ করি,আর যেন আর আমার পিছনে নাহ আসে।বুঝিনি এতেই কাজ হবে। আসেও নি।আমিও ভেবেছি ঝামেলা হয়ত মিটে গেছে।
এরপর বাবা পাড়ার মোড়ে একদিন মাথাঘুরে অসুস্থ হয়ে পড়ে যায়।পাড়ার কয়েকজন ছেলে তাকে নিয়ে বাড়িতে আসে।ওই ছেলেগুলোর মধ্যে সেই ছেলেটিও ছিল।চোখে চোখ পরাতে মাথা নিচু করে থাকে।বাবা সুস্থ হয়ে তার প্রশংসা করে।
-বুঝলে মা,সৃষ্টিকর্তা আজ নিজ হাতে তার প্রেরিত ফেরেস্তাকে এই ছেলে রুপে পাঠিয়ে আজ আমাকে রক্ষা করেছেন।নইলে আজ তোমার এই বাবাকে আর দেখতে পেতে না।হঠাৎ করে মাথা ঘুরে পরে গেলাম।অল্পের জন্য পাশের পুকুরে ডুবে মরিনি।এরা হ্যাঁ এরাই এসে আমাকে উদ্ধার করলো।কিভাবে যে এদের ধন্যবাদ জানাবো।
আমিও চুপ করে রইলাম।নিজের অপরাধের কথাও গোপন রেখে বললাম, বাবা তুমি এখন ঘুমাও।তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন।
তিনিও বাবার খেয়াল রাখা উচিত বলে দলবল নিয়ে চলে গেলেন।
একদিন আমি বাসার বাহিরে কোন এক কারণে বের হই।হঠাৎ একটা মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে।আমার সমবয়সী। এরপর আলাপ হয়,জানলাম আমার পরের ব্যাচে পড়ে। পাশের বাসার মেয়ে।মাবিহা নাম।বেশ ভাব হয় আস্তেআস্তে আমাদের মধ্যে।মাঝে মধ্যে বাসাও আসত মাবিহা।ভালোই সময় কাটাতাম।
প্রতিদিনের মত আমিও সেদিন কলেজ যাচ্ছিলাম।হঠাৎ সেই ছেলেটিকে রাস্তায় দেখতে পেলাম।এরপর আমার সামনে এসে দাঁড়াল, আমার হাত-পা যেন ঠান্ডা হয়ে এলো।ভয়ে কেমন যেন হয়ে গেলাম।আমাকে প্রথমে অভয় দিল। তারপর ভালোলাগা,ভালোবাসার কথা জানালো।আমি প্রচুর ভয় পেয়ে গেলেও তাকে রিজেক্ট করতে ভুলি না।একটু কড়া ভাবে বলি,আমাকে আর কোন দিন ফলো কিংবা ডিস্টার্ব করলে বাসায় জানাব।বেচারা মুখ কালো করে চলে যায়।
আমি স্বাভাবিক ভাবে কলেজে গেলেও কারো সাথে সেয়ার করি নাই।কিন্তু ঘটনাটা আমাকে ভাবায়।
কিছুদিন পর মাবিহার জন্মদিন,আমার দাওয়াত ছিল ওর বাসায়।আমি ছাড়াও আরো কিছু বন্ধু আসে মাবিহার।সবার সাথেই পরিচয় হয়। বেশ মজাও হয়।কিন্তু কেক কাটা হচ্ছে নাহ। সবাই উপস্থিত তাকলেও মাবিহার বড় ভাই অনুপস্থিত। আর তাকে ছাড়া মাবিহা কোন ভাবেই কেক কাটতে রাজি নয়।আমরা সবাই ওনার জন্য ওয়েট করতেছি।হঠাৎ তিনি হুড়মুড় করে ঘরে ডুকে পরেন।আর মাবিহাকে সরি বলেন।ভাই-বোনের অভিমান-অভিযোগ শেষেনওর কেক কাটা হয়।আমি এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকি। আমি মাবিহার ভাইকে চিনতে পারি, একটুও ভুল হয় নাহ। এটা সেই ছেলেটাই, যাকে আমি রিজেক্ট করলাম কয়দিন আগে।মাবিহা তার ভাইয়ের সাথে আবার আমার পরিচয় করে দেয়।নাম জানলাম শীতল।আমি বিব্রত বোধ করছি এটা হয়ত উনি বুঝতে পেরেছেন। তাই দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়।
দুইদিন পর মাবিহা আমাদের বাসায় আসে।আমি জানতাম না,মাবিহা সবটা জানত।মাবিহা আমাকে আবার বলে নতুন করে।আমি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।তাও সে বলে,কতটা ভালোবাসে শীতল আমাকে।কিন্তু আমি মাবিহার জন্মদিনে থাকব,এটা শীতল জানত না।
আমিও একগুঁয়ে, প্রেম-ভালোবাসা এগুলো আমাকে টানে না।ভয় পাই এইসবে।মাবিহাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, আমাদের বন্ধুত্ব রক্ষা করতে চাইলে নেক্সটে আমাকে এসব নাহ বলাই ভালো হবে।মাবিহা রীতিমত মন খারাপ করেই চলে গেল।
সাপ্তাহ দুইয়েক পর মা বলতে লাগল,মাবিহার ভাই শীতল নাকি গতকাল ইতালি গেছে। স্কলারশিপ পেয়েছে প্রথমদিকে দিকে নাকি যেতে চায়নি।লাস্ট সাপ্তাহে ব্যাগ গুছিয়ে হঠাৎ চলে গেল। বড় ভালো ছেলেটা।আমি হা করে কথাগুলো শুনলাম।মাবিহাকেও মনে পড়ল,সেই থেকে তো ওর সাথে আমার কথাও হয়নি।
ছুটে গেলাম ওদের বাড়ি।বাড়ির পরিবেশ বেশ থামথমে।মাবিহাকে নিয়ে বাহিরে এলাম। মাবিহা বলল,ভাইয়া এবারও যেতে চায়নি।কিন্তু এভাবে রিজেক্ট হাওয়ার পর আর দেশেই থাকবে নাহ বলে সিদ্ধান্ত নিল।জীবনে প্রথমবার সে কাউকে ভালোবাসল আর রিজেক্টও হল।অনেকটা অভিযোগর সুরে বলা কথাগুলো। আমিও বললাম,দেশের বাহিরে পড়তে যাওয়া তো ওনার জন্য ভালোই হয়েছে। ভালো ক্যারিয়ার হবে।মাবিহা বলল,এর আগেও স্কলারশিপ পেয়েছে, যায়নি। প্লিজ তুমি একবার ভেবে দেখো।এবার অভিযোগ নয়,যেন অনুরোধ দেখলাম।এরপর আমিও ওকে শান্তনা দিলাম,পড়াশোনা শেষ হলে ভেবে দেখবো।তবে এর মধ্যে অন্য কোথাও নিজেকে জড়াবো না।মাবিহা বেশ খুশি হয়।
এরপর শীতলকে সে জানায়। এমনি কি বাসাতেও জানায়।ওদের বাসায় সবাই বেশ খুশি হয়।কারণ,সবাই আমাকে পছন্দ করত। আমার বাসাও বাদ যায় নাহ।বাবা - মাকে মাবিহার পরিবার ম্যানেজ করে নেয়। দুই পরিবারের মধ্যে একটা আত্নীয় আত্মীয় ভাব।বাবা-মা আগে থেকেই শীতলকে ভালো ছেলে -ভালো ছেলে বলত।তবে আমি শুধু বলেছিলাম ভেবে দেখবো।আর পরিবার বিয়ে পাকা করে ফেলল।আমিও বাঁধা দিলাম নাহ।আমারও দূর্বলতা ছিল হয়ত প্রকাশ করিনি। যাক ভালোই হল।আর নিজেকে লাকি মনে হল,এমন টা কয়জনের হয়।
এরপর ভালোই কাটছিল দিনগুলো।শীতলের সাথেও মাঝে মাঝে আমার কথা হত ফোনে।এমন করেই বছর খানেক গেলো।কিন্তু পৃথিবীতে নেমে আসল করোনার মহামারি। ইতালি হয়ে যায় মৃত্যুপুরী।সবার মাঝে একটা আতঙ্ক, অস্তিরতা।দুই পরিবার একটা মানুষকে নিয়ে খুব চিন্তিত। সারাক্ষণ ফোনে কথা বলা।খোঁজ খবর রাখা। আমাকে একদিন ফোন করে অনেক কিছু জানাল,হয়ত আমি সেগুলো আগে জানতাম নাহ।আমাকে নিয়ে তার স্বপ্ন, সংসার, ভালোবাসা সহ সবটা জানাল। আমি শুধু শুনছিলাম আর চোখ মুছতেছিলাম।কিন্তু শেষের কথাটায় আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম।সে করোনায় আক্রন্ত।হয়ত সেদিনটাই তার সাথে আমার শেষ কথা। (আক্রান্তের কথা আমরা কেউ জানতাম না)। কেমন যেন অস্থির হয়ে গেলাম।আমিও তো তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি।তবে দুজনের স্বপ্ন কি এখানেই শেষ। আর কি হয়ে উঠবে নাহ এগুলো বাস্তবতায়।
অবস্থা দিন দিন বেগতিক হয়ে যাচ্ছে।অনেক লাশের ভিরে হারিয়ে গেল শীতলের লাশটাও।
শীতল আর নেই।এটা যেন কোন ভাবেই আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।চারিদিকে কেবল অন্ধকার দেখি।মাবিহা ছুটে আসে আমার কাছে।আমাকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে থাকে।ভাইকে শেষ দেখা দেখার আকুতি,ভাইয়ের লাশ ছুঁয়ে দেখার ব্যকুলতা মাবিহার।আর আমি....সেটা না হয় নাই বা বললাম।অপূর্ণতায় রেখে গেলাম।শিতলের জন্য বুকের ভেতরে গভীর এক শীতলতা অনুভব করলাম।যে শীতলতা আমাকে পুড়ে ছাই ভস্মীভূত করে দিচ্ছিলো আমার ভেতর বাহির অন্তর। আর বার বার নিজেই দায়ী মনে করতে থাকলাম। আমি বছরখানেক আগে আজকের দিনটার মত করে তাকে ভাবলে হয়ত তাকে পেয়েও যেতাম।
মরিয়ম মেরিনা
কুড়িগ্রাম।
0 মন্তব্যসমূহ
মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।