সাল ১৯৬৯ বাবা এসএসসি পরিক্ষার্থী। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার। পরিবারের ছোট ছেলে আমার বাবা।মেট্রিক পরিক্ষা দিবেন।ব্রহ্মপুত্র নদ বেষ্টিত ঝুনকারচর বর্তমানের ভারতের ধুবরী জেলা লাগোয়া।পরিক্ষা দিতে চাইলে কুড়িগ্রাম মহকুমায় যেতে হবে।সে সময়ে কুড়িগ্রাম মহকুমায় যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।যথারীতি ৩ ঘন্টা নৌকায় ব্রহ্মপুত্রে দাড় টেনে যাত্রাপুর ঘাটে পৌচ্ছাতে হয়।সেখান থেকে গরুর গাড়ি অথবা ধুলোমাখা পথ পায়ে হেটে ধরলা নদীর ফেরি ঘাট।সকাল বেলা বাসা থেকে বেড়ুলেও ধরলার ফেরিঘাট আসতে আসতে সন্ধ্যা নামতো।তারপর ফেরিতে চেপে কুড়িগ্রাম মহকুমা শহর।সেখানে থাকবেন কার বাসায়।আত্নীয় বলতে কেউ নেই।বোর্ডিং ভাড়ার টাকা দাদীর টুপলী থেকেই সংগ্রহ হয়েছিল কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য দাদী সিদ্ধান্ত নিলেন বাবার পরীক্ষা দেওয়া হবে না।একবছর না পড়লে কিছু হয় না।বাবা পড়া ছেড়ে দিয়ে বাসায় থেকে গেলেন। জড়িয়ে পড়লেন স্থানীয় রাজনীতির সাথে।রাত দিন বিভিন্ন চরে চরে ঘুরে কি সব আলোচনা করে বেড়ান। শহর থেকে লোকজন যায় তাদের সাথে ঘুরেন।তাদের কে ভারতে যাওয়ার রাস্তা বাতলে দেন।সে সময়ে ব্রহ্মপুত্র নদ তীরবর্তী অংশে কোন কাঁটাতারের বেড়া ছিল না।শহরের লোকদের সাথে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর দাদীর ভাল লাগতো না।তার সেই অপছন্দের মধ্যে জ্বালানি সংযোগ করেন স্থানীয় মাদ্রাসার হুজুর।ছেলে না কী শহরের লোকদের সাথে পাকিস্থান বিরোধী চক্রান্তে যুক্ত হচ্ছে।দাদী তার নিকটআত্নীয় বোনের মেয়ের সাথে বাবার বিয়ে দিয়ে দিলেন।উদ্দেশ্য বিয়ে দিলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবে।
বাবা ঘরে ফিরলেন কিন্তু তার ফেরা বেশী দিন স্থায়ী হলো না।১৯৭১ সাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের ডাকে দেশ মুক্তি সংগ্রামে উত্তাল।বাবা আবারো জড়িয়ে গেলেন তার পুরাতন বন্ধুদের দলে। মা তখন গর্ভবতী। সারা দিন বন্ধুদের সময় দিয়ে বাবা গভীর রাতে বাসা ফিরতেন।এ নিয়ে মায়ের কোন অভিযোগ ছিল না।একদিন ভোর রাতে বাবা শুধু মাত্র দাদীর জন্য একটি চিঠি রেখে মায়ের কাছে বিদায় নিলেন। ঘর থেকে মিলিয়ে গেলেন অন্ধকারে। মুক্তি সংগ্রামে। তার পর ২২ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে বাবা সহ তার ৩ জন বন্ধুকে কুড়িগ্রাম মহকুমার মোঘলবাসা এলাকায় 'জিগামারি ঘাটে'র কাছে অস্ত্রহীন ভাবে রাখা হয়েছিল, জিগামারী ঘাট ব্যবহার করে পাক বাহিনী কোন দিকে যায় তার গতিবিধি নজর করার জন্য। এই ডিউটির এক মাসের মাথায় আমার ভাইয়ের জন্ম হয়। জিগামারী ঘাটে বাবার কাছে খবর আসে। বাবা তার সন্তানকে দেখতে বাসায় ফেরেন। তার পর বাবা আর যুদ্ধে অংশ নেন নাই। গ্রামে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন,এলাকার মানুষদের সংঘটিত করেছেন,কিভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়। মহকুমা শহর থেকে আসা মুক্তিফৌজদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন আর আমার মা ও ভাইয়ের পাশে ছিলেন। তার পর দেশ স্বাধীন হলো বাবা যুদ্ধ করেন নাই তাই তিনি মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেন নাই। সে সময়ের একটি সাধারণ মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধাদের সনদ আজ যে এতো সোনার হরিনের মতো দামী হবে সেটা কে ভেবেছিল? যাই হোক দেশ স্বাধীনের পর বাবাকে অত্র এলাকার গ্রাম পুলিশের দায়িত্ব দেওয়া হয়।বাবা কয়েকবছর নিষ্ঠার সাথে সে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে শুনেছি।তারপর ১৯৭৫ সালের কালো অধ্যায়।বাবা তাঁর কাজ ছেড়ে দিলেন। এক তিনি পড়াশুনা করেছেন তাই গ্রামের কৃষাণী কাজে বাবা দক্ষ নন অন্যদিকে রাজনীতির সাথে চলার ফলে তার উড়ালচন্ডি ভাবের জন্য এলাকায় কাজ জুটলো না।কিন্তু ততোদিনে আমাদের পরিবারে খাবার নতুন মুখ জুটেছে ৪ জন।বাবা দিশেহারা হয়ে পড়লেন।মায়ের কথায় বাবা যুক্ত হলেন বড় আব্বার ব্যবসায়।
ছোট ব্যবসায় বড় পরিবার অনেক কষ্টে দিন চলে যাচ্ছিলো আমাদের জীবন।বাবা আজ অবদি সংসার নামক বোঝা টেনেই চলছেন। আমাদের ৯ ভাইবোনদের পড়াশুনা করিয়েছেন।কোনদিন তার না পাওয়া কষ্টের কথা বলেননি। কিছুদিন আগে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নিবন্ধন ফরম পূরণের জন্য বাজারে কম্পিউটারের দোকানে গিয়েছিলাম। সেখানে অনেক কোটা দেখে মুখ ফসকে বলে ফেললাম ভাই, কৃষি কোটা নাই? আমার বাবা কৃষক ছিলেন।দোকানি মৃদু হাসলেন।পাশে বসে থাকা একজন লোক কি বুঝলো জানি না, বললো মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে কৃষকের মূল্য বেশি আছে।দেশ ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে ভরে গেছে।তার কথার কোন উত্তর দেইনি। কারণ বাবার বারণ ছিল মুক্তিযুদ্ধ সহ যেসব বিষয় চোখে দেখো নাই সেগুলো নিয়ে তর্ক করবি না। কিন্তু তর্কে না গেলেও লোকটির কথা শুনে ৬ দিন আমি ভাল ঘুমাতে পারিনি। একটু ডিপ্রেশনে ছিলাম,একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি আমাদের এতোটুকু শ্রদ্ধাবোধ নাই? তাদের মূল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠে,তাদের নামের পাশেও ভূয়া ট্যাগ লাগে?
সেই ভদ্রলোকের ভাষায় ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা কারা,তাঁদের কারা সৃষ্টি করেন। কারা ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার জন্ম দেন?অথচ সেসময়ে নাকী ২-৩ হাজার টাকায় যুদ্ধ না করেও অনেকে সনদ নিয়েছেন। বাবা নেননি কেন? আমি ভাবী কত বোকা আমার বাবা। ইস! যদি মুক্তিযুদ্ধের সনদটা থাকতো।?নাকি বাবা আগেই টের পেয়েছিলেন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা নামে একটি শব্দ যুক্ত হবে বাংলা অভিধানে? অতঃপর বিড়বিড় করে বলি তুমি সত্যি বোকা বাবা। আজ বাবা দিবসে তোমাকে বলতে চাই বোকা বাবা তোমায় খুব ভালবাসি। তোমায় সেলাম।
-জাহানুর রহমান খোকন
0 মন্তব্যসমূহ
মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।