0000

শূণ্য সুতা || জাহানুর রহমান খোকন


 এক.

ফিরোজ সরকার অনার্স শেষ করেছেন দু'বছর হলো। বাবার মৃত্যুর পর বড় ছেলে হিসাবে তাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে।বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি বিক্রি করে দুই দুইটা বোনের বিয়ে দিয়েছেন, নিজের এবং পরিবারের খরচ চালিয়েছেন কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে। তাছাড়া গতবছর মায়ের অসুস্থতার সময় নালিয়ার বিলের দুই বিঘা জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি করে দেওয়ায় সেখানে আর দোখন্দি আবাদ হয়না। বর্ষা মৌসুমে পানির নিচে তলিয়ে থাকে। তাই বাসায় ভাতের অভাব থাকে বছরের ছ'মাস। পরিচিত আত্নীয় স্বজনরা বলাবলি করে ছেলেটা একদম বাবার মতো হয়েছে। ঘরঘ্যাঙটা। ফিরোজ সরকারের বন্ধু বান্ধবরা পড়াশুনা শেষ করে ঢাকা ও সিরাজগঞ্জে চাকুরিতে ঢুকেছে। ফিরোজ বাসায় তার ছোট ভাই, স্কুল পড়ুয়া বোন এবং অসুস্থ মাকে রেখে ঢাকায় আসতে ভরসা পায়নি। বন্ধু-বান্ধবরা ফিরোজকে ঢাকায় ডাকেন। ঢাকায় আসলে কাজের অভাব নাই। বেকার বাসায় বসে থেকে সে জিবনটা শেষ করতেছে। গ্রামের মুস্তফা মাস্টার ফিরোজকে ডেকে বলেন, 'তুমি আমাদের স্কুলের সবথেকে মেধাবী ছাত্র ছিলে, তুমি ঢাকায় যাও, দেখবে কোন না কোন চাকুরী হয়েই যাবে।বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তোমার সনদ দেখালেই তারা তোমায় নিয়ে নিবে।এতো ভাল রেজাল্ট করা লোকজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পায়না। আমার বিশ্বাস তোমার ভাল জায়গায় চাকুরী হবে। প্রয়োজনে তুমি গার্মেন্টস এ যাও তবুও গ্রামে থেকো না।'
মুস্তফা মাস্টার ফিরোজকে খুব ভাল বাসতেন। গ্রামে মাদক দ্রব্য সহজলভ্য হয়ে গেছে, মাদকসেবী ছেলেদের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলছে।তাইতো  গ্রামের অর্ধ শিক্ষিত ও অশিক্ষিত ছেলেদের সাথে না মিশে ঢাকা যাওয়ার জন্য ফিরোজকে পরামর্শ দিতেন। আর ফিরোজ মাস্টার মশাইয়ের কথায় ঢাকা এসেছেন তিন দিন হলো। মুখে মিষ্টি কথার বোল ফুটলেও যে ভিতরে ভিতরে আত্নীয় স্বজনরা বাসায় অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথিতে বিরক্তবোধ করে তাই ফিরোজ সরকার সদরঘাটের কাছে একটি কমদামী আবাসিক হোটেলে উঠেছে। আবাসিক হোটেল বলতে একটি টিনের বাড়ি যেখানে কিছু ব্যাচেলর চাকুরীজীবি ও কিছু মার্কেটিংয়ের লোকজন মিলে একসাথে দিন ভাড়ায় থাকে।কমন গোসলখানা।তাই সকালে সরকারী অফিসে নিম্নপদস্থ চাকুরীজীবী ও বেসরকারি চাকুরীজীবীদের সাথে অনেকটা প্রতিযোগিতা করে লাইনে দাঁড়িয়ে গোসল করতে হয়।মার্কেটিংয়ের অফিসাররা এদের একটু পরে বেড়িয়ে পরেন। তখন পুরা আবাসিক হোটেলটি ভুতুরে বাড়িতে পরিনত হয়।
সকালে ফিরোজ সরকার গোসলের লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার সময় একজন মার্কেটিংয়ের লোকের সাথে আলাপচারিতায় তার ঢাকা আসবার কারণ জানায়। সেই সাথে তার সব পরীক্ষার ফলাফল যে ফাস্ট ক্লাস সেটাও গর্বের সাথে বলে দেয় এবং লোকটিকে জানায় সে যে বন্ধুদের ভরসায় ঢাকা এসেছেন তাদের কোম্পানিতে লোক নিয়োগ বন্ধ রয়েছে তাই যদি তিনি ফিরোজকে একটি কাজ জোগাড় করে দেন তবে ভাল হয়। আনোয়ার হোসেন ফিরোজের দিকে একপলক তাকান। তারপর জিজ্ঞাসা করেন এর আগে কোথায় চাকুরী করেছেন। ফিরোজ আগে কোথাও চাকুরী করেনি শুনে আনোয়ার হোসেন ব্রাশ থুথু ভরা মুখে রেখেই বলেন, ভাই এই লাইনে প্রথম আইছেন তো তাই জানা নাই,কিন্তু জানা দরকার। কোম্পানীর চাকুরীতে সনদ দিয়ে কোন কাম নাই আপনার কত বছরের অভিজ্ঞতা আছে হেইডাই আসল। তবে গার্মেন্টস এ গেলে অন্য বিষয়...। এমন সময় বাথরুম থেকে একজন বের হতেই আনোয়ার হোসেন কাউকে সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে গিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা আটকিয়ে দিলেন।আনোয়ার হোসেনের দৌড় দেখে ফিরোজ মুচকি মুচকি হাসে আর ভাবে এভাবে দৌড়ালে আন্তর্জাতিক দৌড় প্রতিযোগিতায় সেরা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর ভাবে চাকুরী কেউ না দিলে অভিজ্ঞতা হবে কোথা থেকে! ফিরোজ সরকারের এই আনমনে ভাবনার মাঝে একে একে লাইনের সকল  লোকজন বাথরুম ও গোসল সেরে কাজে চলে যাওয়ার পর সে গোসল করে বাসা থেকে নিয়ে আসা লন্ডি করা শার্ট-প্যান্ট ও একাডেমিক এবং অন্যান্য প্রশিক্ষণ মিলে মোট বাইশটি সনদ নিয়ে বেড়িয়ে পরে চাকুরীর সন্ধানে।
শরৎকালে গ্রামে হালকা দক্ষিণা বাতাস থাকে এবং তুলনামূলক গরম কম থাকে কিন্তু ঢাকা শহরে তীব্র ভ্যাপসা গরমে ফিরোজ সরকার সদরঘাট থেকে গাজিপুরের উদ্যেশ্যে বাসে উঠে পরেন।সকালে ব্রাশ করার সময় আনোয়ার হোসেনের গার্মেন্টসে অন্য বিষয় কথাটি তার মাথায় ঢুকেছে। এছাড়া ফিরোজ গ্রামে শুনেছে গার্মেন্টসে সহজে চাকুরী পাওয়া যায়।তাই এই ভ্যাপসা গরমে বাসে বসে থেকে ফিরোজ ভাবে একটি গার্মেন্টসে চাকুরী হলে তারপর সেখান থেকে অন্য চাকুরী খোঁজা যাবে। টঙ্গী গাজিপুরে গার্মেন্টস বেশী তাই সেখানেই চাকুরী পাওয়ার সম্ভাবনা বেশী তাই বাস টঙ্গী আসতেই ফিরোজ নেমে পড়লো। কিন্তু আসে পাশে প্রায় ১০ টি গার্মেন্টসে খোঁজ নিয়ে দেখলো কোন কর্ম খালি নাই। চোখে মুখে হতাশা নিয়ে যখন সে চৌরাস্তার দিকে যাত্রা শুরু করলো তখন পেটে ক্ষুধার জ্বালা আচ করতে পেরে সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখলি বেলা গড়িয়ে পরেছে পশ্চিম আকাশে। সকালে হোটেলে পাতলা ডাল ও আলু ভর্তা দিয়ে বেশী ভাত খেতে পারেনি। ফিরোজ আশেপাশে তাকাচ্ছে আর সামনের দিকে হাটছে।যদি কোন ছোট ভাতের হোটেল পাওয়া যায় তবে দুপুরের খাওয়াটা কম টাকায় খেয়ে নিতে পারবে।

দুই.
চৌরাস্তার দিকে হাটতে হাটতে ফিরোজের মনে পরে বন্ধু রফিকের কথা। রফিক ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকুরী করে। গ্রামে একসাথে উচ্চমাধ্যমিক পাশ দেওয়ার পর রফিক ঢাকায় এসে গার্মেন্টসের চাকুরীর পাশাপাশি ফ্যাশন ডিজাইনে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করেছে। এখন সে ঐ গার্মেন্টসের মস্তবড় অফিসার। রফিককে বললে সে নিশ্চয়ই কোন একটা চাকুরী ম্যানেজ করে দিতে পারবে। ফিরোজ নোটবুক থেকে রফিকের নাম্বার বের করে কল দেয় বিপরীত পাশে রিং বেজেই যাচ্ছে কিন্তু রফিক ফোন ধরে না। ফোন না ধারায় ফিরোজ বরং খুশিই হয়। রফিক তার কাছের বন্ধুদের একজন গাজিপুরে আছি শুনলে ডেকে তারপর কথা বলতো,ফোনে কোন কথাই সে শুনতে চাইতো না।গত ঈদে সে ফিরোজের নাম্বার সেভ করে নিয়েছে নিজের ফোনে তাই সে কোন না কোন একসময় তার ফোন কল ব্যাক করবেন। আর নিজের চাকুরীর কথাটা তখনই ফোনে বলা যাবে।এতে লজ্জা কম পাওয়া যাবে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ফিরোজ। আর ভাবে রফিকের ওখানেই সে চাকুরী করবে। তাই অন্য কোথাও আর খোঁজ না করে নোটবুক বের করে বন্ধু আজাদের নাম্বার খুঁজতে থাকে। আজাদ, রফিক আর ফিরোজ স্কুলের টপ ক্লাস ছাত্র ছিল। আজাদ এসএসসি পাশের পর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করে ঢাকায় বিএসসি করেছে। এখন একটি কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট কোম্পানীতে ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কর্মরত আছে। ঢাকায় একজন শিল্পপতির মেয়েকে বিবাহ করে ঘরজামাই থাকে।তার শ্বশুর মেয়ে ও জামাইয়ের নামেই একটি ফ্লাট বরাদ্দ করে দিয়েছেন। আজাদ গ্রামে গিয়ে অনেকবার তাকে আসতে বলেছে। লাঞ্চের সময় শেষ হতে এখনো অনেক সময় বাকী, বাইরে অযথা লাঞ্চ না করে আজাদের কাছে গেলে সে নিশ্চয়ই লাঞ্চের সময়ে ভাত খাওয়াবে।পকেটের অবস্থা ভাল নয়।গ্রাম থেকে যে টাকা নিয়ে এসেছে তা প্রায় শেষের দিকে,আজাদের ওখানে খেলে শ'খানেক টাকা বেঁচে যাবে। যেহেতু হাতে আজ আর কোন কাজও নেই তাই সে আজাদকে ফোন করে। একবার রিং হতেই বিপরীত পাশ থেকে ভেসে আসে আজাদের কন্ঠস্বর।
-দোস্ত কেমন আছিস?শুনলাম ঢাকায় এসেছিস। উঠেছিস কোথায়? কালিয়াকৈরে আমার এখানে চলে আসলি না কেন?
ফিরোজ সরকার উৎফুল্ল চিত্তে জবাব দেয় দোস্ত, আমি তো সদরঘাটে উঠেছিলাম কিন্তু আজ চৌরাস্তায় আছি।
বিপরীত দিক থেকে আজাদ বলে উঠে তুমি এক কাজ করো কালিয়াকৈরে চলে আসো। সাক্ষাতে সব কথা হবে বলে ফোনটা রেখে দেয়। ফিরোজ পেটের ক্ষুধাকে সংবরণ করে বলে, আজাদের ওখানে গেলে কতকিছু খাওয়া হবে। আরতো মাত্র কিছুদূর পথ। বলেই সে লেগুনা বাসে উঠে পরে কালিয়াকৈরের উদ্যেশ্য। কিছুক্ষণের মধ্যে কালিয়াকৈরে পৌচ্ছে যায়,দেখা হয় বন্ধু আজাদের সংঙ্গে দুজনে দু'জনকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রইলো অতঃপর আজাদ বললো আমি তোর জন্য দুপুরে এখনো লাঞ্চ করিনি। চল হোটেলে খেয়ে নেই। 
-কেন রে বাসায় ভাবী নাই?
-আছে কিন্তু তুই এসেছিস না। সেইটা তো জানানো হয়নি। তাই হোটেলে খেতে হবে।
তারপর দুই বন্ধু মিলে খেতে খেতে অনেক আলাপচারিতার মাঝে ফিরোজ জানায়, সে সদরঘাট হোটেল ছেড়ে দিয়ে এসেছে।এখন কয়েকদিন কোথাও থাকা দরকার। রফিকের সাথে যোগাযোগ হলেই সে তার গার্মেন্টসে চলে যাবে। ফিরোজে এ কথাটি শুনে যেন আজাদের মন হঠাৎ করে খারাপ হয়ে গেল। আজাদ আমতা আমতা করে বললো বেশতো আমার বাসায় থাকবি কয়েকটা দিন। দাঁড়াও আমি তোর ভাবীকে ফোন দেই। আজাদ ফোন দিয়ে তার বৌকে বন্ধুর কথা জানাতেই বিপরীত পাশ থেকে আজাদের স্ত্রীর কর্কশ শব্দমালা ভেসে আসলো কিন্তু কথামালা স্পষ্ট বুঝা গেল না। ফোন কেটে আজাদ কৃত্রিম হাসি হেসে জানালো বন্ধু হয়েছে কি আজ আমার শ্বাশুড়ির জন্মদিন তাই বাসায় পার্টি হবে। এজন্য তোমার ভাবী বলছিলেন তুমি অপরিচিত মানুষের মাঝে এসে যদি ইতস্তত বোধ করো তাই আজ তোমাকে এখানে আমাদের কোম্পানীর একটি গেস্ট হাউজে রেখে যাই। কাল লোকজন চলে গেলে বাসায় নিয়ে যাবো। এছাড়া সকালে তো আবার দেখা হবেই।
ফিরোজ সরকার বন্ধু আজাদকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, দোস্ত আমি সত্যি তোমাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চাইনি। যাই হোক তুমি বাসা যাও।আমাকে আজ আবারো সদরঘাটের হোটেলে যেতে হবে সেখানে একটা জিনিস রেখে এসেছি। নেক্সট টাইম আসলে দেখা হবে। আজাদের দেহে যেন প্রাণ ফিরে এলো সে বললো, ঠিক আছে আজ তাহলে যাও, তবে পরেরবার আসলে কিন্তু আমার বাসায় থাকতে হবে। তোমার ভাবী নাহলে খুব মন খারাপ করবে।
বন্ধুর কাছে বিদায় নিয়ে ফিরোজ বাস স্টান্ডের দিকে পা পাড়ালো। সদরঘাটের কথাটা সে মিথ্যা বলেছিল। ফিরোজ বাড়ি আসবার জন্য গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে চলে আসে আর ভাবে স্কুলের মধ্যে বাঘের মতো দাপটের বন্ধুটি আজ ঘরজামাই থেকে কিভাবে বিড়াল হয়ে গেল। এমন সময় মাস্টার মশাই ফোন করেন, ফিরোজ আমাদের গ্রামের করিম শেখ এখন গাবতলীর বড় ব্যবসায়ী। উচ্চ মহলের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে তার উঠাবসা আছে। উনি আমায় ফোন দিয়েছেন একটা চাকুরীর বিষয়ে। আমি তোমার কথা বলেছি। তুমি তার সাথে দেখা করো।তোমার বাবা সরকারি চাকুরীর কপাল। আমি ম্যাসেঞ্জারে তাঁর ঠিকানা পাঠায় দিচ্ছি।

তিন.
ওয়েটিং রুমে এসি চলছে তবুও বিন্দু বিন্দু ঘামে ফিরোজ সরকারের শার্টের উপরিভাগের অংশ প্রায় ভিজে গেছে।তার ভিতরে চরম উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা কাজ করছে। ভিতরের ভাইভা কক্ষ থেকে যেকোন মুহূর্তে তার ডাক আসতে পারে।যদিও করিম শেখ তার চাকুরীর কথা পাকা করেছেন।করিম শেখ আগে গ্রামেই থাকতেন। গাবতলীর গরুর ব্যাপারী বন্ধুর সাথে সখ্যতা গড়ে উঠার পর তার ছোট বোনকে বিয়ে করে শ্যামলীতে একটি দোতলা বাসায় থাকেন। লোকমুখে শুনা যায় শ্যামলীর ঐ বাড়িটি তার শ্বশুর যুদ্ধের সময় একটি হিন্দু পরিবারকে ভারতে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবার বদলে নামমাত্র দামে নিয়েছেন। করিম ব্যাপারী টাকা পয়সার মালিক হওয়ার সাথে সাথে নাম পরিবর্তন করে ব্যাপারী থেকে শেখ হয়ে যান। রাজনৈতিক উচ্চ মহলের ব্যক্তিদের সাথে তার উঠাবসা আছে। ফিরোজ সরকারের চাকুরীটি তিনিই পাকা করেছেন। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় করিম শেখ বারবার করে বলেছেন গাবতলীর মাজার রোর্ডের বাবার মাজারে দুই রাকাত নফল নামাজ পরে তারপর  ভাইভা বোর্ডের সামনে নিজেকে ভালভাবে উপস্থাপনের কথা বলেছেন। মাজারের বাবা জ্যান্ত পীর কামেল। তার বিশ্বাস বাবা যদি খুশি হয় তবে চাকুরী হবে। পীর বাবার খেদমত করেই আজ তিনি করিম ব্যাপারী থেকে করিম শেখ হয়েছেন। ফিরোজ ভাইভার টেনশনে মাজারে যাওয়ার কথা ভুলে গেছে আর এজন্য এখন বেশী টেনশন হচ্ছে। বাবা যদি অখুশি হয় তবে চাকুরীর সম্ভাবনা শিকায় উঠবে। অথচ আজ ভাইভা দিতে আসার আগে সে মাকে ফোনে জানিয়েছে মা চাকুরীটা হবে। আমি ঢাকায় এনে ভাল ডাক্তার দিয়ে তোমার চিকিৎসা করাবো।
এমন সময় কম্পাউন্ডার এসে ডাকলেন ফিরোজ সরকার কেউ আছেন?ভিতরে আসেন।
ফিরোজ নামে অন্য কেউ আছে কি না ভেবে ফিরোজ এদিক ওদিক তাকালেন। কম্পাউন্ডার ছেলেটি বিরক্ত হয়ে আবারো ডাকলো ফিরোজ নামে কেউ নাই? এবার ফিরোজ উঠে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে ভাইভা বোর্ডের কক্ষে প্রবেশের আগে আস্তে করে বললো, ' মে আই কাম ইন স্যার।' ফিরোজের ধারণা তাকে প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার সাথে সাথে শুরু হবে ত্রিমুখী প্রশ্ন। হয়তো সে বসার সুযোগই পাবে না কিন্তু তার সকল চিন্তার অবসান ঘটিয়ে ভাইভা বোর্ডের কর্মকর্তা বললেন, আসুন। বসুন।
ফিরোজ তার জন্য রাখা নির্ধারিত আসনে বসে ফাইল থেকে তার কাগজপত্র বের করতে যাচ্ছেন এমন সময় কর্মকর্তা দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী বললেন, 'আরে রাখেন কাগজপত্র। এসব দেখার অনেক সময় পাওয়া যাবে।আগে বলেন করিম শেখ আপনার কে হন।'
-গ্রাম সম্পর্কে মামা করে ডাকতাম। 
-তা আপনার মামাকে কত টাকা দিলেন?
ফিরোজ সরকার কোন টাকা দেননি এমনকি তার সাথে কোন টাকা পয়সার আলাপ হয়নি শুনে কর্মকর্তা দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী ও তার বোর্ডের সকলে অবাক হলেন। করিম শেখ বিনাপয়সায় কাউকে সরকারি চাকুরীতে সুপারিশ করবার লোক নয়। নিশ্চয়ই লোকটার অন্য কোন মতলব আছে। ভাইভা বোর্ডের কর্মকর্তা দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী ফিরোজের সকল সনদ মনোযোগ সহকারে দেখেন। সব বিষয়ে ফাস্ট ক্লাস। দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী ফিরোজের কাগজের একটি সেট রেখে দিয়ে ফিরোজকে বলেন, আপনি এখন আসুন। আমরা আপনার সাথে পরবর্তীতে যোগাযোগ করবো।
ফিরোজ সরকার ভাইভা বোর্ড থেকে বের হয়ে মাস্টার মশাইকে ফোন দেন। মাস্টার মশাই বলেন, বাবা আমি জানি তোমার চাকুরীটা হবে। করিম শেখ চাইলে চাকুরী না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু বাবা একটা শর্ত আছে সেইটা যে তোমাকে বলা হয়নি।
-কি শর্ত স্যার।
-করিম শেখের একটি মাত্র মেয়ে আছে,তুমি দেখেছো নিশ্চয়ই।তার ইচ্ছা তোমার মতো কোন মেধাবী ছেলেকে দিয়ে তিনি তার মেয়ের বিয়ে দিবেন।আর জামাইকে তিনি ছেলের মতো নিজের বাসায় রেখে দিতে চান। বুঝই তো এতো সম্পত্তি। কোন ছেলে নাই। তাছাড়া মেয়েটিও সুন্দর।উজ্জ্বল শ্যামলা, একটু শর্ট কিন্তু হাই হিল পড়লে বুঝা যায়না। ফিরোজ মুস্তফা স্যারকে বলেন, স্যার আমার বিধবা মা গ্রামে একা। ছোট ছোট ভাইবোন।
সেইটা নিয়ে তুমি ভেবনা। তোমার মায়ের সাথে আমি কথা বলবো বলে মাস্টার মশাই ফোন রেখে দেন।
ফিরোজ পার্কে বসে স্তম্ভিত হয়ে ভাবতে থাকেন। এসময় তার মনে ভেসে উঠে বন্ধু আজাদের কথা। বেচারা আজাদ স্কুলের লিডার ছিল আর আজ ঘরজামাই থেকে সে বউয়ের ভয়ে বন্ধুকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার সাহস পায়না। যদি তার বেলায় এমন ঘটে। যদি তার বিধবা মা ও ছোট ভাই বোনদের টাকা পয়সা দিতে না দেয়। না ফিরোজ আর ভাবতে চায়না। সে এ বিয়ে করবে না। ঘরজামাই থাকার চেয়ে গ্রামে ফিরে গিয়ে বাবার রেখে যাওয়া জমিতে কৃষি কাজ করে খাওয়া ভাল।এসব ভাবতে ভাবতে ফিরোজ পার্কের ব্রেঞ্চে ঘুমিয়ে পরে। পাশে সেলফোনটা বেজেই চলছে।  অর্ধঘুমে একবার চোখ খুলে স্কিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো করিম শেখের নাম্বার। পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে দেখলো সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। হয়তো তার বাসায় যেতে দেড়ি দেখেই করিম শেখ ফোন দিয়েছে। ফিরোজ সিদ্ধান্ত নিলো আর করিম সাহেবের বাসায় সে যাবে না। সোজা বিমানবন্দর রেল স্টেশনে চলে আসে। ট্রেন আসতে আর মাত্র ২০ মিনিট বাকী। ফিরোজ সরকার একা প্ল্যাটফর্মে বসে আছেন। এমন সময় সেলফোনটা আবারো বেজেই চলে। ফিরোজ স্কিনের দিকে না তাকিয়েই ফোন রিসিভ করে বিপরীত পক্ষকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলে, 'আমি ঘর জামাই থাকবো না। আমায় ক্ষমা করুন।'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Back To Top