মেয়েটি প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষার শেষে দাদা বাড়িতে বেড়াতে আসতো৷ সে আমার ছোট বোনের প্রিয় বান্ধবি৷ দু'বছরের ছোট৷ নাম জবা৷ ওর বাবা একটা স্কুলের শিক্ষক৷ নদী পরিবেষ্টিত পাশের জেলা শহরে থাকলেও যোগাযোগ জটীলতায় সর্বদা যাতায়াত করা যেত না৷ ওরা বেড়াতে আসলে একটানা এক-দেড়মাস থাকতো৷ ছোট বোনের বান্ধবি আবার বাড়ি লাগোয়া৷ যার কারণে ও দিনের প্রায় বেশিরভাগ সময় আমাদের বাড়িতেই কাটায়৷ আমরা ছোট মানুষ৷ তাই সকলে একসঙ্গে খেলি৷ ছেলে-মেয়ের বিভেদ নেই৷ অবশ্য সে সময় এটাই প্রচলিত ছিল৷ ওর সাথে আমার সখ্যতা ছিল বেশ৷ সবসময় কেয়ার করতো৷ খেলতে গিয়ে আমি একটু ব্যাথা পেলে ও কান্নাকাটি করতো৷ সবাই ক্ষ্যাপাতো! কিন্ত আমরা ওসব পরোয়া করতাম না৷ আবার সারাদিন ঝগড়া, মান-অভিমানও চলতো সমান তালে৷ ঝগড়া লাগলে আড়ি দিতাম৷ আবার কিছুক্ষণ পর আড়ি খুলে ফেলতাম৷ আড়ি দেয়া এবং খোলার পদ্ধতিটাও ছিলো বেশ! দুজনের কনিষ্ঠ আঙ্গুল বাঁকা করে লাগালে আড়ি বলবৎ আর বৃদ্ধাঙ্গুল লাগালে আড়ি রদ৷ দিনে পাঁচ-সাতবার তো হতোই৷
এভাবেই সময় চলে যায় তার নিজস্ব গতিতে৷ পরবর্তিতে সে এসএসসি পাশ করে শহরেই কলেজে ভর্তি হলো৷ হোস্টেলে না থেকে দাদা বাড়ি থেকেই কলেজ করতো৷ হোস্টেলে থাকবেই বা কেন নিজের বাড়ি থাকতে?
ও যখন ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলো৷ আমি তখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে৷ একই কলেজ৷ ইচ্ছে করলে একই সাথে যাতায়াত করা যায়৷ কিন্ত সামাজিক কারণে সেটা সম্ভব হয়নি৷ ও রিক্সায় যেতো৷ বাবা আমাকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছে৷ ফনিক্স সাইকেল৷ ডুপ্লিকেট ফনিক্স নয়৷ চায়না ফনিক্স৷ তখন এই সাইকেল ছিল একটা এসেট৷ একটা স্ট্যাটাস৷ আমি রাজকীয়ভাবে সেটাতে করে যাতায়াত করি৷ কলেজে দেখা করি৷ কথা বলি৷ কিন্ত ফরম্যাল৷ অন্যরা বিশেষ করে কলেজে পড়ুয়া পাড়ার অন্য প্রতিবেশিরা কী চোখে দেখে! তাছাড়া এখনতো আর সেই ছোট্টটি নেই৷ কিন্ত বাড়িতে ফিরলে আর ফরম্যালিটির কোন বালাই নাই৷ টোকা-টুকি, কিল-ঘুসি, মান-অভিমান সবই চলে৷ জবা প্রচন্ড অভিমানী আর সাহসি টাইপের মেয়ে৷ যার কারণে এতো বড় হয়েছি তবুও দুষ্টুমি করতো খুব৷ একদিন আমি গোসলখানায় গোসল করতে গেছি৷ আগে গোসলখানাতো এতো বাহারি আর নিরাপদ ছিল না৷ চারিদিকে তিন ইঞ্চি ইটের গাঁথুনি দেয়া প্লাস্টার বিহীন ওয়াল৷ উপরে কোন ছাদ নেই৷ দরজাও নেই৷ গোসলখানার ঠিক পাশেই নলকুপ৷ পুরো জায়গাটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা৷ ব্যাস! গোসলের কাপড় রাখতে হয় ওয়ালের উপর৷ সেদিনও আমি গোসল শেষে ওয়ালের দিকে হাত দিয়ে দেখি কোন কাপড় নেই! ফাপড়ের মধ্যে পড়লাম৷ বিব্রতকর অবস্থা! এখন বেড়াই কী করে? কাপড়গুলোই বা কোথায় গেল? এমন সময় কলের পাড় থেকে জবা হেসে বলতে থাকলো এখন তুমি নেংটু হয়ে বের হও৷ আমার সাথে মাতব্বরির শাস্তি! অনেক অনুরোধ করলাম৷ শুনলো না৷ বরং বলে উঠলো তুমি সবকিছু ঠিকঠাক ঢেকে রাখো আমি ভেতরে যাচ্ছি৷ কোন মানাই সে শুনলো না৷ গেটহীন গোসলখানায় ঢুকে পড়লো৷ নিজের দুহাত দিয়ে যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ স্থান ঢেকে রাখা যায় শুধু সেটাই চেপে ধরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক সুন্দরী তরুনীর সামনে দন্ডায়মান গুহা যুগের এক আদিম পুরুষ (Caveman). নিমিষের ভেতরে আদিম প্রবৃত্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো৷ নিয়ন্ত্রন হারিয়ে জবার হাতটাকে ধরে এক ঝটকায় কাছে টেনে আনলাম৷ শক্ত করে চেপে ধরলাম বুকের ভেতর৷ ওর ঠোঁটে এঁকে দিলাম ভালোবাসার উষ্ণ চুম্বন৷ লজ্জায় ও পালিয়ে গেল তখনই৷ প্রথম উপলদ্ধি হলো আমরা একে অপরকে ভালোবাসি৷ এই ঘটনার পর ও দিন দুয়েক আমার সাথে দেখা করেনি৷ না কলেজে আর নাতো বাড়িতে৷
সময় থেকে থাকে না৷ সময়ের সাথে সাথে আমাদের ভালোবাসার শেকড় প্রোথিত হয় আরো গভীরে৷ দুই পরিবারও ইচ্ছুক যেন আমাদের বিয়েটা দিয়ে সম্পর্কটাকে আরো দৃঢ় করে৷ দিনে দিনে আমরা হয়ে গেলাম আরো সাহসি৷ এখন প্রায় প্রতিদিনই পাড়ার মোড়ে দুজনে নাস্তা খেতে যাই৷ মাঝে মাঝে আমার ছোট বোন থাকে৷ কখনো দুজনেই যাই৷ পাড়ার মোড়ের দোকানে আর কী পাওয়া যায়? পিয়াজু, বেগুনি কিংবা আলু চপ৷ জবার ওগুলোই পছন্দ৷ তাছাড়া তখনো এতো থাই-চাইনিজ রেস্তোরার প্রচলন খুব বেশি হয়নি৷
সবই ঠিক ছিল৷ কিন্ত জবার এক চাচা যিনি খাদ্য অধিদপ্তরে কেরানি পোস্টে চাকুরী করার কারণে অবৈধ টাকার মালিক বনে গেলেন৷ টাকার গরমে আস্তে আস্তে তিনি এবং পরিবারকে প্রতিবেশি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন৷ বাড়ির কাঠামো, লাইফ স্টাইল সবই পরিবর্তিত হলো৷ বন্ধ হয়ে গেল জবার সাথে আমার অবাধ যোগাযোগ৷ কিছুদিন আমরা কলেজেই মেলামেশা করতাম৷ তা-ও বন্ধ হয়ে গেল এক সময়৷ কথায় বলে যে অর্থ আর ক্ষমতা মানুষকে নেগেটিভ আর উচ্চাভিলাশী করে৷ জবার ক্ষেত্রেও তাই হলো৷
বেশ কিছুদিন কথা বলতে না পারাতে একদিন এক সন্ধ্যায় জবাকে বাড়ির সামনের রাস্তায় জাম গাছটার নীচে আসতে বললাম৷ কথা রাখলো৷ ও যখন আসলো তখন রাস্তাটা ফাঁকা৷ কেউ নেই৷ নেই কোন শব্দ৷ শুধু গাছ থেকে দু'একটা জাম পরার টুপ টুপ আর আমার বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দ ছাড়া নীরব চারিদিক৷ ও আসা মাত্রই হাতটা ধরে ধরে বললাম তুমি কি আমাকে চাওনা? নাকি আর ভালোবাসো না! কেন আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ? সে খুব স্বাভাবিক আর শান্ত স্বরে জানালো আমাদের সম্পর্ক আর রাখা সম্ভব নয়৷ কেননা বড় চাচা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন৷ ছেলে সরকারি চাকুরে৷ আমাকে ক্ষমা কোরো৷ বলে চলে গেল৷ আমি কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ একাকী৷ কষ্ট পেয়েছি কিন্ত কাঁদিনি৷ বরং কেন যেন প্রচন্ড শব্দে হেসেছি৷
এরপর সময় বয়ে যায় তার নিজস্ব গতিতে৷ হঠাৎ বাবার মৃত্যু! সংসারের দায়িত্ব, ভাই বোন ও নিজের লেখাপড়া৷ বোনের পাত্রস্থ৷ নিজের একটা চাকুরী৷ সব মিলে একটা ঘোরের মধ্যে সময় চলে গেল৷ সব কিছু গুছিয়ে উঠে যখন বিয়ে করবো দেখি বয়স অনেক হয়ে গেছে৷ কেউ পাশে নেই৷ একা৷ ভীষণ একা৷ শুধু কাঁধে যার প্রেরণার হাত পেয়েছিলাম৷ সে হলো রত্না৷ আমার কাজিন৷ অনেক ছোট৷ কিন্ত ও আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে৷ রত্না আমার দ্বিতীয় প্রেম৷ জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সময়ে ওর হাত দুটি ছিলো আমার শক্তি৷ অন্ধের ষষ্ঠি৷ অনেক স্বপ্নের জাদুকর৷ জীবন সঙ্গীনী৷ দুটি সন্তান নিয়ে আমাদের ছোট্ট সংসার৷
আমি একটা মার্কিটিং ডিপার্টমেন্টে জব করি৷ পেশাগত কারণে আমাকে বিভিন্ন জেলাতে থাকতে হয়৷ বাড়িতে থাকা হয় কম৷
জবা মাঝে মাঝে এখনো স্বামী সন্তানসহ এখানে আসে৷ শরীর ভর্তি গহনা৷ রঙ বেরঙের পোষাক৷ কিছু নারীর মধ্যে এই পাগলামো দেখা যায়৷ গহনা আর পোষাক প্রদর্শন করে প্রমাণ করতে চায় যে তারা কত সুখী৷ ওর দুটি মেয়ে৷ বিয়ে দিয়ে দিয়েছে৷ এখন জবার আনাগোনা আরো বাড়তে লাগলো৷
প্রায় মাস খানেক পর বাড়ি ফিরলাম৷ সপ্তাহ খানেক ছুটি নিয়েছি৷ রত্না আর সন্তানদের মতো আমিও ভীষণ খুশি৷ কটা দিন আনন্দে কাটানো যাবে৷ সেদিন শুক্রবার বিকেলে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বের হয়েছি৷ একটু ঘুরবো বলে৷ বাড়ির গেটে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো জবার সাথে৷ বুকটা ধক্ করে উঠলো৷ বিশ্রী একটা পরিস্থিতি৷ ঘামতে থাকলাম৷ কেমন আছো? বলে জবা পরিবেশটা স্বাভাবিক করলো৷ বললাম ভালো আছি, ধন্যবাদ৷ তুমি? ও মাথা উপর নীচ করে জানালো ভালো আছে৷ আচ্ছা দেখা হবে বলে আমরা বেরিয়ে পরলাম৷ রিক্সায় রত্না বারবার আড় চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে৷ কারণ আমার আর জবার বিষয়টা ও জানে৷
পরেরদিন সন্ধ্যায় জবা আমাকে সেই জাম গাছটার নীচে দেখা করতে বললো৷ আমি জানালাম এর কোন প্রয়োজন নেই৷ কিন্ত ওর অনুরোধে দেখা করতে গেলাম৷
দুজনে মুখোমুখি৷ দামি পোষাক আর গহনায় মোড়া সামনে দন্ডায়মান জবাকে মনে হচ্ছে যেন শপিং মলে দাঁড়ানো "ডেমো পুতুল"৷ হঠাৎ জবা আমার হাত দুটো ধরে বলে উঠলো তুমি কি আমাকে এখনো ভালোবাস? চলো আমরা নতুন করে জীবন শুরু করি৷ আমি বিশ্মিত! কিছু বলবার আগেই কাঁদো কাঁদো স্বরে ও বলতে শুরু করলো৷ জানো জীবনে আমি কিছুই পেলাম না৷ টাকাওয়ালা ঐ অসৎ বুড়োকে বিয়ে করে জীবনটাই শেষ করে দিলাম৷ তুমি কি আমাকে আগের মতো গ্রহণ করবে? বিশ্ময়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে আমি একবার জবা আর একবার ওর হাত দুটোর দিকে তাকাতে লাগলাম৷ আধো আলো আর আধো অন্ধকারে ওকে কেন যেন রাক্ষুসে মনে হচ্ছে৷ চামড়া কুচকানো আর বলিরেখা ভরা হাত দুটো যেন আমার গলা টিপে ধরবে৷ ভয় নয় বরং ঘৃণায় পিছু হটতে লাগলাম৷ যে নারী একদিন নিজের ইচ্ছায় পছন্দের বিত্তবান মানুষটাকে বিয়ে করলো৷ হোক বৈধ কিংবা অবৈধ উপায়ে যার উপার্জিত অর্থে নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করলো৷ সংসার করলো৷ আজ তাকেই অপবাদ দিচ্ছে৷ আর বিশ্বাস ঘাতকতা করে অন্যের ঘরনী হতে চায়৷ ৫০ পেরুনো মেনোপজে পৌঁছানো এক বিকারগ্রস্থ নারীর পরকীয়ার প্রস্তাব আমাকে রত্না'র প্রতি ভালোবাসাকে তীব্র করে তুললো৷ এত কিছুর পরও রাক্ষুসেটাকে কৃতজ্ঞতা জানালাম মনে মনে৷ কেননা ওর প্রত্যাখানের জন্যই রত্না'র মতো রত্ন আমি পেয়েছি জীবনে৷
এখানে এক মূহুর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না৷ রত্না'র স্যাক্রিফাইজ আর ভালোবাসা ভীষণভাবে উপলদ্ধি করলাম৷ ফিরে যেতে চাই সেই মানুষটার কাছে৷ যে শত বিপদের মাঝে আমাকে দিয়েছে সাহস৷ দিয়েছে নতুন ভাবে বাঁচবার প্রেরণা৷ সেই রত্নার কাছে৷ যেমনটি আগেও ছিলাম৷
আমি দৌড়াতে থাকলাম বাড়ির দিকে৷ অল্প দূরত্ব৷ আমি ঘেমে যাচ্ছি৷ দম কমে যাচ্ছে৷ কিন্ত কোন ভাবেই জবা'র থেকে দূরত্ব বাড়াতে পারছি না৷ সেই মেনোপেজকালীন ডাইনী থেকে যে এই বয়সে এসেও পরকীয়া প্রেমের প্রস্তাব দেয়৷
3 মন্তব্যসমূহ
Thanks
উত্তরমুছুনসুন্দর গল্প, ভাল লাগিছে আমার। এরাম গল্প আরো পড়বার চাই। লিখক ও সম্পাদকের নিকট কৃতজ্ঞিতা।
উত্তরমুছুনছি ময়না তোর এত অধপতন হইছে ???? এসবকে তুই গল্প বলিস ?? আর সম্পাদকের কি সাধারন শিক্সাও নাই এসব প্রকাশ করে
মুছুনমন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।