এক.
অতঃপর চাচা যেদিন বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে উপরের দিকে শেষ নিশ্বাস উর্ধ্বেটান দিচ্ছিলেন, মুখদিয়ে কোন কথা ফুটছিল না। সেদিন সারারাত বাড়ির পিছনের আ'গাছে একটি পেঁচা বিষাদস্বরে কান্না করে যাচ্ছিলো। আমার বিধবা দাদী কয়েকবার ঘরের বাইরে গিয়ে পেঁচাটিকে তাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। পেঁচাটি উড়ে যায় কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে এবং পূর্বের তুলনায় আরো বেশী করে কান্না শুরু করে। প্রতিবেশী আটপৌরে বিধবা নারীরা কানাকানি করা শুরু করেছে এটা পেঁচা নয়, সাক্ষাৎ যম। করিম মোল্লা মনে হয় আর বাঁচবে না। কেউ কেউ তাদের অতীতের স্মৃতিচারণ করতেছে, কবে তার আত্নীয়ের শিথানের কাছে পেঁচা ডেকে যাওয়ায় সে কিভাবে মারা গেছে তার বিষদ বর্ণনা। তাকে আবার কেউ কেউ বলছে থাক না এসব কথা এখানে কিন্তু পরক্ষণেই সেই মহিলাই আবার খুঁচিয়ে দিচ্ছে তারপর কি সে সত্যি সত্যিই মারা গেছে। তাদের এইসব আলাপচারিতা এবং একটু পরপর আমার দাদীর হাউ মাউ করে কেঁদে উঠার মধ্যদিয়ে আস্তে আস্তে রাত পেরিয়ে ভোর হলো। পেঁচাটি তার ডানা বিকট শব্দে ঝাপটায় তিনবার চেঁচিয়ে উড়ে গেল এবং যাওয়ার সময় ডানাদুটি এতো জোড়ে ঝাপটালেন যেন দীর্ঘদিনের অব্যবহিত জঙধরা ডানা দুটির সাথে তার দেহকে বিছিন্ন করে ফেলতে পারলে সে মুক্তি পায়। আর সেসময়ে শোবার ঘরে চাচা তিনবার পানি পানি করে উঠলো। পাশে বসে থাকা দাদী চাচার মুখে দুই চামচ পানি তুলে দিলেন। করিম চাচা এক চামচ পানি ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে ফেললো,আর তার দু'চোখের মনিকোঠা দিয়ে টপটপ করে অশ্রুপাত হয়ে থাকলো। চাচা আমাদের সকলের মায়া ত্যাগ করে বিদায় নিলেন। সেদিন শরতের শুভ্র সকালে হঠাৎ করে মুশুলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। করিম মোল্লার করোনা হয়েছে এ খবর আগেই পাড়ায় রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল তাই প্রতিবেশী কেউ এগিয়ে আসলো না। আমার এক সন্তানের জননী অষ্টাদশী চাচী দরজার পাশের হাতল ধরে ফুপিয়ে কান্না করে উঠলেন, দাদী হাউ মাউ করে ডুকরে উঠলেন আর আমার বাবা নীরবে চাচার চলে যাওয়া ফ্যাকাসে মুখটার দিকে তাকিয়ে দু'ফোটা অশ্র ফেললেন। গত একমাস ধরে চাচার জ্বর-সর্দি, কাশি থাকায় চাচাকে নিয়ে সদর হাসপাতাল ও ডাক্তারের চেম্বারের ঘুরেফিরে চাচার নিশ্চিত মৃত্যু মেনে নিয়ে আমি অনেকটা শক্ত অবস্থানে পৌঁছে গেছি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, আমি ছাতা মাথায় পাড়ার মুসল্লীদের চাচার মৃত্যু সংবাদটা পৌচ্ছে দিতে বেড়িয়ে পরলাম।
পাড়ার মসজিদে পীরে পয়গম্বর করিম মোল্লার মৃত্যু সংবাদ প্রচারের জন্য হাজির হলাম। সেখানে চাচার তাবলীগের মুসাফির সাথি ফজল মুন্সিকে দেখতে পেয়ে চাচার মৃত্যু সংবাদটা জানালাম তিনি চাচার আত্নার জন্য মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করলেন কিন্তু আমার বাসায় করোনা উপসর্গ নিয়ে করিম চাচা মারা যাওয়ায় আমাকে মসজিদে প্রবেশের অনুমতি দিলেন না। তিনি আমার হয়েই মসজিদের চাচার মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করলেন। মসজিদে উপস্থিত মুসল্লীদের আমি আমাদের বাড়িতে চাচার দাফনকার্য সম্পাদনের বিষয়ে আলাপ করার জন্য দাওয়াত দিয়ে আমি বাসায় ফিরলাম।
দুই.
দুপুর ২ টা বাজে ৩০ মিনিট। চাচা মারা যাওয়ার প্রায় ৭ ঘন্টা গত হয়েছেন। আমার চাচীর বাবার বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছিল তারা বৃষ্টি ও লকডাউনের দোহাই দিয়ে আসতে পারবে না বলে দিয়েছেন। আমার চাচার দাফনে অংশ নিতে কেউ আসলো না কিংবা আমার অষ্টাদশী চাচীকে দুইটি সান্ত্বনা দিতে প্রতিবেশী কোন নারী এগিয়ে এলোনা। এলাকার গোরস্থানে গেলাম কিন্তু সেখানকার খতিব জানিয়ে দিলো করোনায় আক্রান্ত মোরদার দাফন এই কবরস্থানে দিতে গেলে মন্ডল সাহেবের অনুমতিপত্র লাগবে। বাবার সাথে কথা বলে আমি আসরের নামাজের পর এলাকার মাতব্বর সুরত মন্ডলের বাড়িতে হাজির হলাম। সেখানে ফজল মুন্সি, কালু শেখ ও রহমত মেম্বার দেখে মনে মনে খুশি হলাম। এনারা সবাই আমার চাচার তাবলীগের সাথী ভাই। নিশ্চয়ই গোরস্থানে চাচার দাফনে তারা মন্ডলসাবকে অনুরোধ করবেন। আমি চোখে মুখে আশা নিয়ে মন্ডলসাবকে সালাম দিলাম।
- সুমন তুমি এসে ভালই করেছো। আমরাও পরামর্শ করছিলাম তোমাকে ডাকবার জন্য দেখো গোরস্থানটা তো আমাদের কারো একার নয়, সকলের মরহুম আত্নীয় স্বজন সেখানে শুয়ে আছে। সেখানে সকলেই তাদের কবর জেয়ারত করতে যান। এমতাবস্থায় একজন করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিকে গোরস্থানে জায়গা দিলেতো অন্য মানুষ কিছুদিন গোরস্থানে যেতে পারবে না।যানই তো এসকল রোগ ছোঁয়াচে।এখন একজনের জন্য তো আমরা বাকী মোরদাদের হক আদায় থেকে বিরত রাখতে পারিনা! তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি গোরস্থানে তোমার চাচার দাফন হবে না।
কিন্তু আমার চাচার তো করোনা পজেটিভ হয়নি।উনি আপনাদের সাথের মানুষ। আল্লাহর পরহেজগার বান্দা ছিলেন। তার মাছ মারার নেশা ছিল আপনারা সকলেই জানেন। বৃষ্টিতে ভিজে মাছ মারায় তার সর্দি-জ্বর হয়েছিল।আর আমার চাচা তো এজমার রোগী সেইটা আপনারা সকলেই জানেন তাই কাশি ছিল। ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেটা জানতো না তাই তারা করোনা রোগী ভেবে হাসপাতালে নেননি কিন্তু আপনারা তো তাঁকে জানতেন। তাহলে আমার চাচার কেন গোরস্থানে দাফন হবে না?
আমার কথা থামিয়ে দিয়ে ফজল মুন্সি বললেন, বাবা সুমন তুমি শিক্ষিত ছেলে। এসকল বিষয়ে আর আপত্তি করনা। বুঝই তো একটি সমাজে বসবাস করতে গেলে সকলের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে চলতে হয়। তাছাড়া গোরস্থান ও বাসায় কবর দেওয়ার মধ্যে তেমন কোন ফারাক নাই। আসল কথাটা হলো কবরে শুয়ে মুর্দা যেন আজান শুনতে পায় সেটাই আসল। আর তোমাদের বাড়িতো মসজিদ থেকে খুব বেশী দূরে না।
এবার মুখ খুললেন রহমত মেম্বার। বাবা সুমন করিম মোল্লা কেমন মানুষ ছিল সেইটা আমরা সকলেই জানি। তোমার চাচার মতো ভাল মানুষ গাও গেরামে খুব কম খুঁজে পাওয়া যাবে। আমি থানায় ফোন করেছিলাম। হয়তো এতোক্ষণে স্বাস্থ্য বিভাগের টীম তোমাদের বাসায় এসে গেছে। তারা তোমাদের বাসার যারা যারা এসময়ে করিম মোল্লার সাথে মিশেছে তাদের সকলের নমুনা নেবেন। আর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের একটি করোনা মুর্দা দাফন কমিটি আছে তারা এসে দাফন করে যাবেন। আমি কথা বলেছি।এলাকার মেম্বার হিসাবে এইটা আমার কর্তব্য। তাছাড়া করিম মোল্লা আমার খাস ভোটার ছিল। এখন কি আর করা যাবে। তুমি বাসায় যাও। আর শুনো একয়েকদিন তোমরা বাজারে বা বাইরে কোথাও যাবে না। তোমাদের বাসায় আমি বাজার পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।
ইচ্ছে করছিলো রহমত মেম্বারের মুখে থুথু দেই। শালা চালচোর মেম্বার। একজন মানুষ মারা গেছে আর সে এসময়েও ভোট হারানোর চিন্তা করে। কিন্তু গতকাল থেকে ভাত পানি না খাওয়ায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। থুথু বেরুনোর কোন সম্ভাবনাই নেই। ব্যর্থা চেষ্টা না করে বাড়ির দিকে হাটা ধরলাম।
বাসার কাছে এসে দেখি সাদা রোবটিক পোষাক পরিহিত ৬ জন ব্যক্তির একটি টীম চাচার শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করছেন। একে একে পরিবারের সকল সদস্যের নমুনা সংগ্রহ করে এবারে তারাই চাচাকে গোসল করালেন। বাড়ির বাহির আঙ্গিনায় বকুল গাছটির নিচে চাচার জন্য গোর খোদাই করা হলো। স্বাস্থ্য বিভাগের করোনায় মৃত্যু ব্যক্তিদের দাফন কমিটির প্রধান নিজেই ঈমামের ভূমিকা নিয়ে জানাজা পড়ালেন। জানাজা শেষে আমি আর বাবা সহ মোট ৮ জন ব্যক্তি মিলে চাচাকে দাফন করলাম। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকেও আমাদের বাড়িটি লকডাউন ঘোষণা করে তারা চলে গেলেন।
তিন.
আজ করিম চাচার করোনা টেস্টের ফলাফল দেওয়ার কথা। জেলা সদর দফতর থেকে ফোন করে আমাকে যেতে বলেছে। ৬ দিন বাসায় বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পেয়ে আজ সাইকেলে করে সদরে গেলাম করোনার ফলাফল আনতে। জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার রুমের সামনে যেতেই তিনি আমাকে চিনতে পারলেন।তিনি আমার হাতে একটি সাদা কাগজে স্বাস্থ্য বিভাগের সীল স্বাক্ষর সহ ফলাফলের কাগজ দিলেন। আর আমাকে বললেন, সুমন এই মাহামারীতে এসে বুঝতে পারলাম আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে। তোমার চাচা এজমার রোগী ছিলেন। তার শরীরে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কোন উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়নি। সঠিক চিকিৎসা হলে হয়তো তিনি আজ বেঁচে থাকতেন। করোনার জন্য তোমরা সঠিক চিকিৎসা পাওনি। বুঝই তো কে কার জীবন বাজি রেখে অন্যের জীবন বাঁচায়। কর্মকর্তার কথাগুলো আমার অসহ্য লাগছিলো। কাগজটি নিয়ে আমি হনহন করে তার রুম থেকে বেড়িয়ে আসলাম। ইচ্ছে করছিলো চিৎকার করে বলে উঠি এখানে কেউ সেবক নন সবাই কসাই কিন্তু পরক্ষণে বাসার সকলের কথা চিন্তা করে নিজেকে সংবরণ করে সাইকেলের উপরে উঠে বসি। বাসার কেউ বাড়ির বাইরে যেতে পারেনা, বাজারে যাওয়া বন্ধ। মিছে এই ডাক্তাররকে গালমন্দ না করে বরং সকলকে পৃথিবীর সমাজ নামক কারাগার থেকে মুক্তি করা জরুরী। সাইকেল চালিয়ে সদর থেকে গ্রামের রাস্তায় এগুচ্ছি। যতই বাসার কাছে যাচ্ছি ততোই নিজেকে ভারী মনে হচ্ছে। চাচার অসুস্থতা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে আমি একটিবারের জন্যও কাঁদিনি। বাড়ির উঠানে পৌঁচ্ছে ফলাফলের কাগজটা পকেট থেকে বের করলাম সেখানে স্পষ্ট লেখা করিম মোল্লা, বয়স ৪০ বছর, ফলাফল করোনা নেগেটিভ। নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারলাম না, চাচার কবরের মাটি আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। আমার কান্না শুনে বাড়ির ভিতর থেকে বাবা দৌঁডে আসলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন কি হয়েছে সুমন খুলে বলো। আমি অনেকদিন পর বাবাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে বললাম, বাবা চাচার করোনা নেগেটিভ এসেছে। পরিবারের সকলের ফলাফল নেগেটিভ। এখন আর আমাদের বাজারে যাওয়া কেউ নিষেধ করতে পারবে না।
এমন সময় চাচার কবরের উপরে টুপ করে দুইটি হলুদ নিমপাতা ঝরে পরলো। আমি সেই হলুদ নিমপাতার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এভাবে কতক্ষণ রইলাম জানি না। রহমত মেম্বারের ভটভটি মোটর সাইকেলের আওয়াজে আমার ঘোর কেটে গেল। দেখি চাচার কবরের পাশে রহমত মেম্বার ও ফজল মুন্সি দাঁড়িয়ে মোজানাজ ধরেছেন। আমিও তাদের সাথে হাত উঠালাম। মোনাজাত শেষে ফজল মুন্সি আমার বাবাকে ও আমাকে ডেকে বললেন, আজতো করিম মোল্লা ইন্তেকালের ৬ দিন হলো, শরিয়তের বিধানমত মুর্দার আত্নার মাগফেরাতের জন্য দোয়া খায়ের করাতে হয়। ফকির মিসকিন খাওয়াতে হয়। আর সেইটা মৃত্যুর ৩য় দিন, ৭ম দিন এবং ৪০তম দিনে করলে ভাল হয়। সেহিসাবে আজ ফলাফল এসে ভালই হয়েছে। আগামীকাল করে ফেলা যায়।
-বাবা আমতা আমতা করে বললেন সেইটা তো করা দরকার কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি লোকজনকে দাওয়াত দেওয়ার বিষয়টা আর আমাদের তো জানেনই অর্থনৈতিক অবস্থা কাম না করলে চলেই না সংসার।
রহমত মেম্বার বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না ভাই। আমরা আছি। সমাজে আমাদের একটা দায়িত্ব কর্তব্য আছে না।আপনি শুধু আগামীকাল সাতদিনি অনুষ্ঠান করবার অনুমতিটা দেন। আজ তাহলে উঠলাম। আগামীকাল বাদ জুম্মা খাওয়াদাওয়া। সকাল থেকে রান্না বান্না শুরু করতে হবে। বাবা সুমন সাইকটা নিয়ে বিকেলে বাজারে আসিও। অনেক খরচপাতি করতে হবে।
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই আর বিষ্ময় নিয়ে ভাবী, যে মুর্দার জানাজা ও দাফনে তারা অংশ নেয়না সেই মুর্দার আত্নার শান্তির জন্য শরিয়ত পালন করে লোক খাওয়ানো কতটা কর্তব্যের!!
0 মন্তব্যসমূহ
মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।