0000

শেষ পর্যন্ত || মরিয়ম মেরিনা



১.

আজ চেয়ারম্যান আজগর সাহেবের বড় মেয়ে লুনার বিয়ে। ফজরের অনেক আগ থেকেই ডেকোরেশনের শব্দ শুনা যাচ্ছে সুর্বণগ্রামে। খিচুড়ি পাকানো হচ্ছে। সবাই নামাজ শেষে এসে খেয়ে কাজে নামবে।


শীত আসবে আসবে ভাব। প্রতিদিনের মত সাত বছরের আসিফ মসজিদের সামনে মকবুলের দোকানের বারান্দায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। আজগর সাহেব নামাজ শেষে বেড়িয়ে ডানে-বামে তাকাতেই আসিফকে দেখতে পায়। তার মেয়ের বিয়েতে কত মানুষ আসবে, খাবে। সেখানে এই অনাথ আসিফকে দু'এক বেলা খেতে দিলে মন্দ হয় না। বিনিময়ে না হয় সে থালা বাসন ধুয়ে দিবে। কিংবা হাতে হাতে একটু কাজ করে দিলেও মন্দ নয়। আয়োজন যত বড়,কাজের লোকের প্রযোজন তত বেশি।

-'এই আসিফ,এই মরার ঠ্যাং,এত বেলায় এই হানে পইরা পইরা ঘুমাচ্ছিস?'

'আমি কোনহানে ঘুমামু,আমার তো ঘর নাই' চোখ মুছতে মুছতে আসিফ বলল।

-'হ,যার বাপ-মায়ের ঠিক ঠিকনা নাই,তার আবার ঘর কি?আমার লগে চল। তোরে খিচুড়ি খাওয়ামু। সারাদিন আজ আমার বাড়িত খাবি আর কাম করবি।'

এটা কোন নতুন ব্যাপার না। এভাবেই সকাল হয় আসিফের। এর-ওর ধাক্কায়, কটু কথা শুনে। এতেই আসিফ অভ্যস্ত। তখন খারাপ লাগলেও একটু পর আসিফ সব ভুলে যায়। লেগে পরে এর-ওর বিনি পয়সার কাজে দু'মুঠো ভাতের আশায়।

বিয়া বাড়ির সামনে বিশাল গেট। তাতে হরেক রকম লাইট। ছোট,বড়,মাঝারি। রঙ বেরঙ এর। গেটের উপরে ইংরেজিতে কি যেন একটা লেখা, তাতে লাইটের আয়োজনটা একটু বেশি। গেট পার হতেই রাস্তার দু'পাশে ঝাড়বাতি, উপরে ঝাড়বাতি। নিচের দিকে তাকালো আসিফ। সেখানে লাল পাটির মত কি যেন বিছানো একদম একটা বড় বসার জায়গা পর্যন্ত। বাড়ির ভিতরটাও অন্য রকম করে সাজানো। কোন কিছুর ত্রুটি নাই। এমন আয়োজন আসিফ আগে কখনো দেখেনি।

খিচুড়ি খেয়ে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল প্লেট পরিষ্কার করতে। সেখানে কমছে কম ১৫০+ প্লেট হবে। তবে আসিফ একা নয়। মরিয়মের মা চাচী আর লিলি বেগম আছে। তিনজনেই পরিষ্কার করল। তাই ততটা বেশি সময় লাগেনি।

বিয়া বাড়িতে মন টিকল না আসিফের। এত মানুষ, এত কোলাহল তার ভালো লাগতেছে নাহ। কেমন যেন মনের ভিতর কু-ডাকতেছে। বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে। মেয়েরা হাতে মেহেন্দি দিচ্ছে। বুড়িরা গীত গাইতেছে।নাঈমের দাদী সেই তালে তালে নাছতেছে। ছেলেরা কাজে ছোটাছুটি করতেছে। চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ের বিয়ে,ত্রুটি হলে সমস্যা আছে।

আসিফ বিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে, পিছনের দিকের রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। সে দেখল লুনা আপা কার জন্যে যেন অপেক্ষা করতেছে জানালার পাশে।চোখ-মুখে কেমন যেন ভয় ভয়। অস্থির লাগতেছে তাকে। আসিফ থালা পরিষ্কার করার সময় শুনছে মরিয়ম চাচী কইছে,পাশের গ্রামের মহবত মিয়ার ছোট পোলার লাইগা লুনা আপার বিয়া হচ্ছে। তারাও খুব বড়লোক। মহবত মিয়া নাকি টাকার তোষকে ঘুমায়।পোলাডা তার বিদেশ থেকে আইছে।মাথায় বড় বড় চুল। গলায় সোনার বড় মালা। হাতে নাকি চুড়িও আছে। খুব ভালো ভাগ্য না হলে নাকি ওমন ঘরের বউ হাওয়া যায় না।

'আসিফ,একটু শুনে যা তো, লুনা বলল।'

আসিফ এগিয়ে যায়,লুনা তার হাতে একটা চিরকুট দেয়। সেটা মিতুরদের বাড়ির লজিং মাস্টারকে দিয়ে আসতে বলে। আর অনুরোধ করে যেন এটা সে কাউকে নাহ বলে। তাকে চকলেট খাওয়ার জন্য একশ টাকার একটা নোট দেয় লুনা। টাকায় হলুদের দাগ। আসিফ প্রথমবার একটা একটা কাজের জন্য টাকা পেল। তবে আসিফ নাঈমের কাছে শুনেছিল,মিতুদের বাড়ির লজিং মাস্টার আসাদের সাথে লুনার নাকি ভাব।একদিন নাকি সন্ধ্যাবেলা তারা দু'জনে হাত ধরে নদীর ধারে যাইতেছিল। সেটা নাঈম দেখছে। তবে সে আসিফ ছাড়া আর কাউকে কয় নাই। ব্যাপারটা জানা-জানি হলে কি হবে,সেটা জানে নাঈম।

আসিফ লেখাপড়া জানে না। স্কুলের সময় সে কখনো স্কুলের বারান্দায় পা দিতে পারেনি। তবে দূর থেকে দেখছে খন্দকার বাড়ির ছেলেরা কি ভাবে স্কুলে যায়।স্কুল ছুটি হলে সে স্কুলের বারান্দায় বসে কত সময় কাটায়। একবার স্কুলের বারান্দায় টানা তিনদিন ছিল।তখন গরমকালের স্কুল ছুটি। সেই তিনদিন তার কি জ্বর। স্কুলের দারোয়ান নিজাম সাহেব তার মাথায় পানি দিয়েছিল দু'দিন। মানুষটা ভালো।

আসিফ ভাবলো চিঠিখানা আসাদ মাস্টারের হাতে দিয়ে সে যাবে একটু নাঈমের সাথে দেখা করতে।অনেকদিন তার সাথে মার্বেল খেলা হয়নি। আসিফের আর মিতুদের বাড়ি যাইতে হয় নাই। সে দেখল,আসাদ মাস্টার পুকুর পাড়ে বসে পানিতে ঢিল ছুরতেছে।

চিঠি খানা তার হাতে দিয়েই। একশ টাকার নোট টাও তার হাতে দিল। সেখানে লুনা আপার গায়ের হলুদের দাগ আছে। বিনিময়ে আসাদ মাস্টার তাকে জোর করে দশ টাকা দিল। কারন,আসাদ মাস্টার বুঝেছিল,টাকাটা লুনা আসিফকেই দিয়েছিল। কিন্তু টাকাতো আসিফের থেকে আসাদ মাস্টারের প্রযোজন বেশি, সেটা ছোট আসিফ জানে। আসাদ মাস্টার আসিফ কে একটা সুখবর দেয়। তার নাকি ঢাকা শহরে বড় চাকরি হইছে।মাসে বিশ হাজার টাকা বেতন। আর তিনদিন পর জয়েন। এরপর সেখানেই থাকবে। আসিফ কখনো ঢাকা গেলে যেন তার সাথে দেখা করে।

২.

একমাত্র নাঈম ছাড়া আসিফকে তেমন কেউ পছন্দ করে না।  নাঈমদের বাড়ির মোড়ে আসিফ শুনতে পেল ঘটনা। স্কুলের দারোয়ান নিজাম নাকি ম্যালা টাকা বাকি খাইছে মকবুল মিয়ার দোকানে। তবে টাকা সে কোনভাবেই শোধ করতে পারতেছে না। শোধ করতে না পারাও একটা কারন আছে। নিজাম একজন নিয়মিত জুয়ারি।  এদিকে মকবুল মিয়ারও টাকার প্রযোজন।  দিনে পাঁচ বার টাকা চায় নিজামের কাছে। সেদিন টাকা চাইলে ক্ষ্যাপে যায় নিজাম। এরপর শুরু হয় কথা কাটাকাটি, তারপর মারামারি আর তারপর রক্তারক্তি।

গ্রামের একভাগ মানুষ চেয়ারম্যান এর বাড়িতে। আবার আর একভাগ মানুষ নিজাম সাহেব আর মকবুল মিয়াকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতেছে। সবার পিছনে নাঈম আর আসিফ। ওরাও যাচ্ছে। 

সবাই রাস্তা দিয়ে গেলেও আসিফ আর নাঈম গেল শটকার্ট আলপথ দিয়ে। কার্তিক মাস। ধানের গাছ বেশ বড়। ধানক্ষেত পার হয়েই হাসপাতালের প্রাচীর। প্রাচীর একাংশ ভাঙা। সেখানেই অকাম হতে শুনেছে আসিফ। তবে সে কখনো সেখানে কিছু দেখেনি। হয়ত গভীর রাতে অকাম গুলো হয়। সেই ভাঙা প্রাচীরের নিচ দিয়ে কোনরকমে ব্যাঙের বাচ্চাগুলোর মত পার হল তারা।এখন কোয়ার্টার এরিয়াতে তারা। এইসব কোয়ার্টারে নাকি বড় বড় ডাক্তার সাহেবরা থাকে। কোয়ার্টার গুলো পার হলেই হাসপাতাল। 

জরুরি বিভাগে সামনে ওরা দু'জন দাঁড়িয়ে আছে।ভিতরে মকবুল মিয়া আর মিজান সাহেব। নিজাম সাহেবের অবস্থা ভয়াবহ। যেকোনো মহুর্তে অপ্রতাশিত কিছু ঘটতে পারে। মকবুল মিয়ার মাথায় ৫ টা সেলাই দেওয়ার পরে স্যালাইন লাগানো হয়েছে। আর নিজাম সাহেবের মাথায় ৮ টা সেলাই দেওয়া হলেও ক্রমাগত সে বমি করছে। মনে হয়,তার ডান পা টাও ভেঙে গেছে। তার মাথার ক্ষতে নাকি গভীরতা বেশি। তাকে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ডাক্তার সাহেব।

নিজাম সাহেবের বাড়ি দেবীগঞ্জে। চাকুরী হাওয়ার পর থেকে এইখানেই তার একা বসবাস। মাসে একবার পরিবারের সাথে দেখা করতে যায়। দু'একদিনের মধ্যেই চলে আসে। কিন্তু আজ তার এই অবস্থায় এমন কেউ নেই যে তার সাথে জেলা সদর হাসপাতালে যাবে।সেখানে রাজি হয়,আসিফ ও নাঈম। সবাই তাতে সায়ও দেয়। আশা করে এতে কোন অসুবিধা হবেনা।হাসপাতলের দেওয়া এম্বুলেন্সে পাঠানো হয় তাদের।মকবুল মিয়ার ছোট ভাই আসিফকে ৫০০ টাকা দেয়।রাস্তায় বিপদ-আপদে লাগতে পারে ভেবে। আসিফ একবার সোহবার চাচার সাথে সদর হাসপাতালে গিয়েছিল। তাই সেখানে পৌঁছানোর পর তার কি করতে হবে তা সে জানে। কিন্তু কপালের লেখা কি আর মুছে ফেলা যায়। মধ্যরাস্তায় মারা যায় নিজাম সাহেব। অবশেষে এ্যাম্বেলুন্স ঘুরিয়ে আনা হয়।

এদিকে হাসপাতালে মকবুল মিয়ার পরিবারের ২জনকে দেখা গেল। তটস্থ তারা। বিষয়টা পুলিশ অবধি গেল।কিন্তু,লাশ পাঠানো নিয়ে ঝামেলা। অবশেষে সন্ধ্যার কিছু আগে লাশ নিয়ে নিজাম সাহেবের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রাওনা হল মনসুর ভাই আর মফিজুল চাচা। ট্রেনে যাইতে হবে। স্টেশন অবধি আসল অনেকেই। লাশ যখন ট্রেনে তুলল সেখানে সব ভাড়া মিটিয়ে দিল একটা পুলিশ। 

এরপর সবাই যার যার মত আফসোস করে বাড়ি ফিরতে লাগলো। কিন্তু গেল না আসিফ। আর নাঈমকেও সে যাইতে দিল না। কিন্তু কারন সে নাঈমকে জানাল না। আসিফ দুটো টিকিট কাটল। টিকিটের দাম মিটিয়ে দিল সেই ৫০০ টাকা দিয়ে। সন্ধ্যার আজান পার হয়ে গেল। তারা তবুও সেখানে বসে রইল। করো জন্য অপেক্ষা করতেছে তারা।আসিফকে চিন্তিত দেখল নাঈম। খানিকটা পায়চারী করে আবার বসে পরে সে। একটু পরেই ৭ টার ট্রেন ছাড়বে। হাতে আর সময় নাই। তবু যেন কেউ আসছে না। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হল।

আসাদ মাস্টারের সাথে লুনা আপা কালো বোরখা পরে আসতেছে। ট্রেন এখুনি ছেড়ে দিব। টিকিট কাটার সময় নাই। আসিফ টিকিট দুটো তাদের দিল। এরপর তাদেরকে ট্রেনে তুলে দিল। তারা ট্রেনে উঠতেই। ট্রেন ছেড়ে দিল। লুনা আপা তাকিয়ে আছে আসিফের দিকে। আসিফ আর নাঈম হাত বাড়িয়ে মৃদু হেসে তাদেরকে বিদায় জানাল।

মহুর্তে ট্রেন টি অদৃশ্য হয়েগেল। সুর্বণ গ্রাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Back To Top